সস্তায় খাবারের স্লোগানে ভোট-বাক্স ভরার তাগিদে চওড়া হবে রাজকোষ ঘাটতি। মুখ থুবড়ে পড়বে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অর্থনীতিও। এই আশঙ্কায় মঙ্গলবার টাকার নিরিখে এক ধাক্কায় ১৯৪ পয়সা বেড়ে গেল ডলারের দর। পৌঁছে গেল ৬৬.২৪ টাকায়। পাউন্ডের দাম দাঁড়াল ১০২.৮০ টাকা। আগের দিনের তুলনায় ২৬৮ পয়সা বেশি।
টাকার এই রেকর্ড পতনের দিনে ৫৯০ পয়েন্ট খোয়ালো বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক সেনসেক্সও। লগ্নির
নির্ভরযোগ্য গন্তব্য হিসেবে আরও চকচকে হল সোনা। কলকাতার বাজারে ১০ গ্রাম পাকা সোনার দর ছুঁল ৩৩,৭০০ টাকা।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন, ঘাটতি না-বাড়িয়েও খাদ্য-সুরক্ষা প্রকল্পে টাকা জোগানোর ক্ষমতা কেন্দ্রের রয়েছে। ফের দাবি করেছেন, টাকার দাম হওয়া উচিত অনেকটাই বেশি। আরও এক বার পরোক্ষে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে দায়ী করে বলেছেন, ২০০৯ থেকে ২০১১-র মধ্যে মন্দা ঠেকানোর লক্ষ্যে উৎসাহ প্রকল্প চালানোর জেরেই আজ বেহাল হয়ে পড়েছে অর্থনীতি। সেই দশা কাটিয়ে ওঠার জন্য সাহায্যও চেয়েছেন বিরোধীদের। তা সত্ত্বেও এ দিন লোকসভায় বাম-বিজেপির প্রবল আক্রমণের মুখে পড়েছে মনমোহন সিংহের সরকার। |
সোমবার লোকসভায় খাদ্য সুরক্ষা বিল পাশ করেছে কেন্দ্র। এর পর রাজ্যসভাতেও তা পাশ হলে দেশের ৬৭% মানুষকে নামমাত্র দামে খাদ্যশস্য জোগানোর দায় নেবে সরকার। বছরে এ জন্য ১ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা দেবে তারা। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঠিক এখানেই আতঙ্কিত বোধ করেছেন লগ্নিকারীরা। কারণ, তাঁরা মনে করছেন, বৃদ্ধি ৫ শতাংশের আশেপাশে থমকে যাওয়ার অর্থ কর থেকে সরকারের আয় কমা। তার উপর আবার এই বিপুল ব্যয়ের বোঝা ঘাড়ে নিলে অবধারিত ভাবে বাড়বে রাজকোষ ঘাটতি। একেই চলতি খাতে বাণিজ্য ঘাটতিতে (দেশে ডলার আসার তুলনায় তা অনেক বেশি বেরিয়ে যাওয়া) রাশ টানতে কেন্দ্র নাজেহাল। তার উপর আবার এই সমস্যাও মাথাচাড়া দিলে, আরও গভীর গাড্ডায় পড়বে দেশের অর্থনীতি। খোয়াতে হতে পারে ক্রেডিট রেটিং-ও (ভারতকে ধার দেওয়া কতটা নিরাপদ, তার মূল্যায়ন)।
এই আশঙ্কাকে এ দিন আরও উস্কে দিয়েছে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম গত পাঁচ বছরের মধ্যে সব থেকে উঁচুতে পৌঁছে যাওয়া। মূলত সিরিয়ায় ডামাডোলের কারণে এ দিন ব্যারেল-পিছু তেলের দর ছিল ১১৩ ডলার। এমনিতেই চড়া ডলারে তেলের দাম মেটাতে কেন্দ্র গলদঘর্ম। এর উপর বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বাড়লে আরও বেশি ডলার গুনতে হবে। মুশকিল হবে চলতি খাতে ঘাটতি কমিয়ে আনা। এই সমস্ত আশঙ্কাই এ দিন ধস নামিয়েছে টাকার দরে। এক দিনের পতনের বিচারে (৩.০২%) যা গত ১৮ বছরে সর্বোচ্চ।
অর্থমন্ত্রী অবশ্য দাবি করেছেন, ভারতীয় অর্থনীতির যা শক্তি বা আয়তন, তাতে খাদ্যসুরক্ষা বিলের জন্য টাকা জোগাড় করা সমস্যা হবে না। হিসাব কষে দেখিয়েছেন, খাদ্যে ভর্তুকি বাবদ ৯০ হাজার কোটি টাকা গত বাজেটেই তুলে রেখেছেন তিনি। যার মধ্যে ১০ হাজার কোটি আবার রাখা হয়েছে খাদ্য সুরক্ষা বিলের কথা মাথায় রেখেই। আশ্বাস দিয়েছেন, খাদ্য সুরক্ষার দায় কাঁধে নিয়েও রাজকোষ ঘাটতিকে লক্ষ্যমাত্রার (জাতীয় আয়ের ৪.৮%) মধ্যেই বেঁধে রাখবেন তিনি। কোনও ভাবেই টপকাবেন না চলতি খাতে ঘাটতির লক্ষ্মণরেখা (জাতীয় আয়ের ৩.৭% বা ৭ হাজার কোটি ডলার)। |
শুধু প্রতিশ্রুতিতে আটকে না-থেকে পরিস্থিতি শোধরাতে দশ দফা পদক্ষেপ করার কথাও ঘোষণা করেছেন চিদম্বরম। তাতে থমকে থাকা প্রকল্পে দ্রুত ছাড়পত্র কিংবা রফতানি চাঙ্গা করার কথা যেমন রয়েছে, তেমনই আছে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি। তুলে ধরেছেন সম্প্রতি দেশে লগ্নি আসার খতিয়ান। দাবি করেছেন, এই সমস্ত প্রকল্প রূপায়িত হতে শুরু করলেই চাকা ঘুরবে অর্থনীতির। বৃদ্ধি ফের ফিরে আসবে ৮%-র ঘরে।
কিন্তু অর্থমন্ত্রীর এই সমস্ত আশ্বাসে এখনও পর্যন্ত কান দেওয়ার লক্ষণ দেখায়নি শেয়ার বাজার, শিল্প কিংবা লগ্নিকারীরা। যেমন বণিকসভা সিআইআইয়ের সভাপতি এস গোপালকৃষ্ণন মনে করছেন, “খাদ্য সুরক্ষার এত বড় খরচ নিঃসন্দেহে প্রভাব ফেলবে রাজকোষ ঘাটতির উপর।” আগে একই ভাবে এই বিল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন ফিকি-র সভানেত্রী নয়না লাল কিদোয়াই। এমনকী এ নিয়ে সম্প্রতি সরকারকে সতর্ক করেছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্কও।
শুধু কেন্দ্রের অনাস্থা নয়। এ দিন সংসদে বিরোধী দলের প্রবল আক্রমণেরও মুখোমুখি হন অর্থমন্ত্রী। তাঁকে ‘অযোগ্য চিকিৎসক’ আখ্যা দিয়ে বিজেপি সাংসদ তথা এনডিএ জমানার অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিন্হা বলেন, অর্থনীতির উপর নিয়ন্ত্রণই হারিয়ে ফেলেছে কেন্দ্র। ফলে তাদের সরে যাওয়াই ভাল। যার উত্তরে চিদম্বরম বলেছেন, “২০০৮ সালেও আপনারা বলেছিলেন আমাদের চলে যাওয়াই ভাল। কিন্তু আমরা ফিরেছি।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ দিন সন্ধ্যায় দেওয়া অর্থমন্ত্রীর আশ্বাস টাকার দর কিংবা শেয়ার বাজারে প্রভাব ফেলবে কি না, তা বুধবার কিছুটা বোঝা যাবে। কিন্তু মার্কিন মুলুক সমেত উন্নত দুনিয়া মন্দা থেকে মুখ তুলতে শুরু করায় ভারতের মতো দেশ থেকে সেখানে লগ্নি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া আপাতত জারি থাকবে। তাই সেই লগ্নির একটা বড় অংশকে টেনে রাখতে অর্থনীতির মূল অসুখগুলি আগে সারানো জরুরি। ফেরত আসা প্রয়োজন আর্থিক শৃঙ্খলা। একমাত্র তবেই শিল্প কিংবা বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারেন বলে মনে করছেন তাঁরা। |