সবাই পি আর করছে, কেউ সমালোচনা করছে না
হৈমন্তী শুক্ল মানেই বড় গোল টিপ, এক ঢাল চুল, চওড়া পাড় শাড়ি, এটা কেন?
তুলনা না টেনেই বলছি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বললেই যেমন সাদা ধুতি আর গোটানো সাদা শার্ট ছাড়া কিছু ভাবা যায় না। আসলে আমার কাছে হৈমন্তী মানেই গোল টিপ, চওড়া পাড়ের শাড়ি। আমি নিজেকে এভাবেই দেখেছি। ছোটবেলা থেকেই সাবেকি সাজই আমায় টেনেছে। অল্প বয়সেও কোনও দিন ঝুঠা গয়না পরিনি। পরলে সোনার চেন, বালা পরেছি। এই ধারাবাহিকতা বরাবরই মেনে চলেছি।

ধারাবাহিকতা কেন? আপনার সাজ দেখে কি দর্শক আসেন?
না, তা একেবারেই নয়। আমি আসলে ক্যারি করার কথা বলছি। পারফর্ম করার সময় লোকে আমায় দেখছেন। তখন যদি মুখ বিকৃত করে, হাত পা নেড়ে, দাঁড়িয়ে, বদখত সেজে গাইতে বসি শ্রোতার তা ভাল লাগবে কেন?

পারফর্ম করার ক্ষেত্রে রিয়্যালিটি শো কতটা জরুরি?
রিয়্যালিটি শো দিয়ে পারফরম্যান্স শেখা যায় না। শ্রেয়া ঘোষালের দক্ষতা কিন্তু রিয়্যালিটি শো তৈরি করে দেয়নি। ওটা একটা বিশেষ ক্ষমতা। এখনকার বাচ্চারা যদিও অনেক অ্যাডভান্স, না বুঝেই তারা গানের নানা দুরূহ অলঙ্কার গেয়ে ফেলছে। সেটা আমায় অবাক করে। কিন্তু এদের প্রথাগত শিক্ষার প্রয়োজন। তবেই ওরা বহু দিন গাইতে পারবে। ডিসেম্বরে আমার পঁয়ষট্টি হবে। কিন্তু গলায় বয়স ধরে না। টিকে থাকতে হবে, আর তার জন্যে চাই সাধনা, শিক্ষা, সহবত, সংযম।

সংযম মানে?
আজকের ফাস্ট লাইফ গানের জন্যে ক্ষতিকারক। সবাই এত স্মোক করে, ড্রিঙ্ক করে, এগুলো গলার ক্ষতি করে। হৈমন্তীর গলা ছাড়া কিছুই নেই। গলার ক্ষতি হোক এমন কিছুই কোনও দিন করিনি, আর করবও না।

বিয়েটাও কি সেই কারণেই করেননি?
বাবা বলতেন, বিয়েথা খবরদার করিস না। এই একটা কথা মনের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। সংসারী হব কখনও ভাবিনি। গানই আমার সব। গানকে আমি কোনও দিন ছাড়ব না, আর গানও আমায় ছাড়বে না।
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
কিন্তু আজও ১৯৭৯-এ রেকর্ড করা ‘এখনও সারেঙ্গিটা বাজছে’ গানটিতে আপনি যখন ‘তোমার দু’হাত ধরে এগিয়ে গিয়ে ভয় হয় যদি তুমি দাও সরিয়ে’-অংশটা গান তখন আপনার যে প্রেম নেই সেটা মানতে ইচ্ছে করে না, প্রেম ছাড়া বলেন কী করে অমন কথা?
আমি খুব রোম্যান্টিক। মনে মনে নিজের পুরুষ হিসেবে যাকে ভেবেছি তার দেখা কোনও দিন পাইনি। তা নিয়ে কোনও আক্ষেপও নেই। কারণ তিনি আমার গানেই আছেন। সেই কারণে ওই ভাবে বলতে পেরেছি।

বন্ধু? সেটাও কি গানে গানেই?
না, আমার প্রচুর পুরুষবন্ধু আছে। পুরুষদের সঙ্গেই আড্ডা, গল্পে আমি অনায়াস বোধ করি।

কয়েক জন পুরুষবন্ধুর নাম বলুন না...
রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় আমার খুব ভাল বন্ধু। খেলোয়াড় সুরজিত্‌ দাশগুপ্তও তাই। ওঁদের সঙ্গে গান থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে মন খুলে কথা বলতে পারি। মান্নাদার সঙ্গেও খুব জমে যেত আমার। বয়সে বড় হলেই বা, বন্ধুতার কোনও বয়স হয় না। ছেলেদের সঙ্গে অনেক কিছু শেয়ার করা যায়। আগেকার গায়ত্রী বসু, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, এঁরা একসঙ্গে আড্ডা দিতেন। এখন তেমন আড্ডা হয় না।

কিন্তু বন্ধু প্রসঙ্গে বিশু চক্রবর্তীর কথা বললেন না কেন? নৌশাদজির কাছে তো উনিই আপনাকে নিয়ে যান?
হ্যাঁ, উনিই নিয়ে যান। আসলে আমার সঙ্গীতজীবনে ওঁর উপস্থিতিতে আমার লাভ-ক্ষতি দু’টোই হয়েছে। ও
অসম্ভব বেশি কথা বলত। আমাকে কিছুতেই বাইরের লোকের সঙ্গে মিশতে দিত না। তখন ছোট ছিলাম, ভাবতাম ওঁর গাইডেন্সটা আমার দরকার। কিন্তু পরে বুঝেছি ও সবার কাছে আমার অহঙ্কারী শিল্পীর ইমেজটাকেই বাড়িয়ে তুলেছিল। যেটা আমি একেবারেই নয়।


আপনি হেমন্ত-মান্না যুগের সাক্ষী আবার চন্দ্রবিন্দু-ভূমিও শুনছেন। আজকের বাংলা গান আপনার কেমন লাগে?
এখন তো শিল্পীরা বলেন, গান গাইতে সুর লাগে না। এখন যে কথা বলার মতো গান হয়, সেটাকে আমি আদৌ গান হিসেবে মনেই করি না। সেটা খুব সুন্দর কবিতা হতে পারে, কিন্তু সেই কবিতার গান হয়ে ওঠা আর হয় না।

আপনি ঠিক কোন গানের কথা বলছেন? যদি একটু উদাহরণ দিয়ে বলেন।
অনেক বাংলা ছবি হচ্ছে এখন, কিন্তু এমন গান হচ্ছে না যেটা ছবির গল্পটাকে আরও এগিয়ে দিচ্ছে। গানটাও আলাদা করে বহু দিন থেকে যাচ্ছে না। ‘এমন স্বপ্ন কখনও দেখিনি’-তো আজও লোকের মুখে মুখে ঘোরে, সে আজকের প্রজন্মই হোক বা আগেকার। এ রকম হয়েছে যে এখন ছবি দেখতে দেখতে মনে হল গানটা ভালই, তবে সেটা ‘ভালই’, ‘ভাল’ নয়।

ভাল নয় এমন গানের কথা একটু বলুন না!
‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ গানটা আমার একদম ভাল লাগেনি।

সে কী? ওটা তো অসম্ভব হিট!
হ্যাঁ, হিট। তবে সেই সুবাদে আড়াই বছরের বাচ্চাও মা কিছু বললে বলছে ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’। আমি হয়তো এ সব খুব কম বুঝি, তাই গানটা ভাল লাগেনি। শিলাজিত্‌ খুব ঝগড়া করেছিল একবার আমার সঙ্গে। বলেছিল আপনাদের গান চল্লিশ বছর থাকলে আমার গানও থাকবে। সময় দিন একটু। কিন্তু ক’জন এখন ‘ঘুম পেয়েছে বাড়ি যা’ শোনেন?

তবে কি আজকের শ্রোতাদের পছন্দ বদলায়নি বলে আপনার মনে হয়?
সত্যিই যদি বদলাত তাহলে আমাকে ঘরে বসে পুজো করতে হত আর বাসন মাজতে হত। আজও আমাকে গান গাওয়ার জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হত না। বাংলাদেশে মনে আছে, একই আসরে ‘এমন স্বপ্ন কখনও দেখিনি’ গানটা আমায় তিন বার গাইতে হয়েছিল। এমন শ্রোতাও আছেন, যাঁরা আমাদের গানই শুনতে চান।

রবীন্দ্রনাথের গানকে আজকাল নানা ধরনের পরীক্ষার মাধ্যমে উপস্থাপনা করা হচ্ছে, আপনার সেটা কেমন লাগে?
রবীন্দ্রসঙ্গীত মানেই কেবল তবলা আর হারমোনিয়াম বাজবে, এটা আমি মানি না। কথা, সুর ঠিক রেখে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যদি উপস্থাপনাটাকে বদলে দিয়ে, দেড়শো বছর আগেকার গীতিকার, সুরকারের গান গায় ক্ষতি কী? আর নাচানাচি করলেও রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়েই তো করছে, করুক না। তবে মিউজিক্যাল যন্ত্রের ব্যবহার জেনে করতে হবে। না জেনে করার প্রবণতাটা যদিও এখন বেশি।

এখন কি তবে কোনও ভাল কাজ হচ্ছেই না? আপনার যদি আজ নতুন কোনও গান গাইতে ইচ্ছে হয়, আপনি কি গাইবেন না?
না, তা কেন? ভাল কাজ হলেও সংখ্যায় তা খুবই কম। নচিকেতা অবশ্যই খুব ভাল কাজ করছে। আমার নতুন গান গাইতে ইচ্ছে হলে আমি নচিকেতার কাছেই যাব। দারুণ কথা লেখে, চমত্‌কার সুর বসায়। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তও চমত্‌কার কাজ করছেন। ওঁর সুরে গাইতেও খুব ভাল লাগে।

আপনি তো স্বাগতালক্ষ্মীর লেখা গানও গেয়েছেন...
হ্যাঁ, ও খুব গুণী মেয়ে। লিখতেও পারে, সুরও দেয়। ওর গান গেয়েও খুব ভাল লেগেছিল আমার।

আজ কাদের গান শুনতে ভাল লাগে?
মনোময় ভট্টাচার্য, শ্রীকান্ত আচার্য। এঁদের গান, ব্যবহার আমার খুব ভাল লাগে। মেয়েদের মধ্যে শুভমিতা ভাল গাইছে। কিন্তু ও আজকাল দু’টো কি-বোর্ড নিয়ে অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে গাইছে। ও খুব ভাল ক্ল্যাসিকাল জানে, আজ যদি ওঁকে খেয়াল গাইতে বলা হয়, ও কি দাঁড়িয়ে গাইবে? একটা কি-বোর্ড নিয়ে গাইলেও ও লোকের মনে অনেক কাল থাকতে পারত।

কোনও আক্ষেপ আছে আপনার?
আক্ষেপ নেই। অনেক পেয়েছি। একটা কথাই মনে হয় গান এখন বড় সস্তা হয়ে যাচ্ছে। সবাই সবার পিঠ চাপড়াচ্ছে। সবাই যে যার মতো পি আর করছে কিন্তু কেউ কারও সমালোচনা করে না।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.