লড়াইটা শেষ করতে চান নির্ভয়ার ভাইরা

ছ’টা বাজতে না বাজতেই ঘুম থেকে টেনে তুলে দিত দিদি। “অত ভোর ভোর... ভাল লাগত না। কিন্তু যত ক্ষণ না ঘুম থেকে উঠব, মাথা খারাপ করে দেবে। না উঠে উপায় ছিল না। স্নান করে এসে দেখতাম দিদি প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে। ওর হাতে রাখি পরেই দিনটা শুরু হত” বলে চলেছেন বছর তেইশের যুবক। আক্ষেপ, “আজ সর্বস্ব বিকিয়ে দিতে রাজি আছি। কেউ যদি ফিরিয়ে দেয় দিদিটাকে। এনে দেয় সেই দিনগুলো। সেই ঘুম জড়ানো চোখে দিদির হাতে রাখি...।”
মুম্বই গণধর্ষণ নিয়ে গোটা দেশ যখন তোলপাড়, দক্ষিণ দিল্লির কলোনির বাড়িতে বসে ক্রমাগত মাথা নাড়িয়ে চলেছেন গৌরব সিংহ। একটা বছর আগেও সব কিছু ঠিকঠাক ছিল। শুধু মাঝের একটা দিন তছনছ করে দিয়েছে তাঁদের দুই ভাইয়ের জীবন। ১৬ ডিসেম্বর এক কনকনে ঠান্ডা শীতের রাতে দিল্লির বাসে নৃশংস ভাবে গণধর্ষণ করা হয়েছিল তাঁদের দিদিকে। শরীরের মধ্যে একটা রড ঢুকিয়ে দিয়েছিল ছয় দুষ্কৃতী। সে নৃশংসতা দেখে আতঙ্কে শিউরে উঠেছিলেন সফদরজঙ্গ হাসপাতালের ডাক্তাররাও। তাঁরা বলেই দিয়েছিলেন, দিদি আর বাঁচবে না। ঘা হয়ে গিয়েছিল অন্ত্রে। অস্ত্রোপচার করে বাদ দিতে হয়েছিল অন্ত্রের বেশ কিছুটা অংশ। অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের বেশ সুনাম আছে। পাঠানো হয় সেখানে। তবে শেষরক্ষা হয়নি। ডাক্তারদের আশঙ্কা সত্যি করে ১৩ দিনের মাথায় শেষ হয় জীবন-মৃত্যুর লড়াই।
তত দিনে ঝড় বয়ে গিয়েছে গোটা দিল্লির উপর। উত্তাল রাজধানীর পথে রোজই ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ। কখনও যন্তরমন্তরের সামনে। কখনও বা রাইসিনা হিলের কাছে। কেউ তাঁদের দিদির নাম দিয়েছে ‘নির্ভয়া’। কেউ ডেকেছেন ‘দামিনী’। কারও মুখে সে হয়ে উঠে দেশের ‘আমানত’। রোজই সংবাদপত্রের শিরোনামে তাঁর নাম। তাঁর পরিবারের কথা।
রাখির দিন সকালে বার বারই দিদির কথা মনে পড়ছিল গৌরবের। মনে পড়ছিল গত আট মাসের ঝড়ঝাপটার কথা। রোজ কাগজে নাম বেরোয় বলে অনেকে শুনিয়েছিল, প্রচারের আলোয় আসতে চায় তাঁরা। “সত্যিই তাই”, বললেন গৌরব। তবে খবরটা যেন হারিয়ে না যায়, লোকে ভুলে না যায়। যেন দোষীদের কঠিন শাস্তি হয়, সরকার যেন ধর্ষণ রুখতে কড়া আইন আনে তাই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আট মাস হয়ে গেল। ফাস্ট ট্র্যাক আদালতে মামলা এখনও চলছে।” মূল অভিযুক্ত রাম সিংহ জেল হেফাজতে মারা গিয়েছে। নাবালক অভিযুক্ত ছেলেটির কী শাস্তি হবে, ৩১ অগস্ট ঘোষণা করবে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ড। “দেখা যাক কী হয়। কিছু না হলে রাষ্ট্রপুঞ্জে যাব। ওখানে নিশ্চয় বিচার মিলবে”, নিচু স্বরে বললেন তেইশের যুবক।
মামা-কাকার মেয়ে রয়েছে। কিন্তু তাদের থেকে আর রাখি পরতে চাননি গৌরব-সৌরভ। “দিদি-ই যখন নেই, ও সব আচার মেনে কী হবে!” বললেন গৌরব। কত মজা করতেন তিন ভাই-বোন, গৌরবের মুখে ঘুরে-ফিরে আসছিল সে কথা। ২০০৯-এ ফিজিওথেরাপির কোর্স করতে দেহরাদূনে যায় দিদি। সেখানে থেকেই পড়াশোনা করতেন। তবু তিন জনের হাসি-ঠাট্টায় এতটুকু ভাটা পড়েনি। “কখনও ও ফোন করত, কখনও আমরা। তবে বেশিটাই মেসেজ করতাম। ফোনে তো খরচ বেশি।” এখনও দিদিকে মেসেজ করেন গৌরব। যেমন দেহরাদূনে থাকার সময় দিদিকে মেসেজ করতেন। রোজ, যা যা হয় “পরীক্ষা কেমন হল। বন্ধুদের কথা। মা আজ কী করল... এই সব।” শুধু কাকে যে পাঠাবে বুঝে পায় না। প্রশ্ন করলেন, “কিসকো ভেজুঁ!” তবু তিনি মেসেজ লেখেন, মনে হয় কোথাও একটা দিদি আছে।
দেহরাদূনে থাকার সময় হাতখরচ তুলতে একটা কল সেন্টারে চাকরি নিয়েছিলেন দিদি। নাইট শিফটে কাজ করতে হত। পরের দিন ভোর বেলা ফোন করে ঘুম থেকে তোলার দায়িত্ব ছিল গৌরবের। নিজে ঘুম থেকে উঠে এ সব উটকো ঝামেলা ভাল লাগত না তাঁর। তবু করতে হত, কত ঝগড়া হত। এটা-সেটা নিয়ে। এখন সে সব ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
দক্ষিণ দিল্লির কলোনিতে সরু গলির মধ্যে বাড়ি। বিদ্যুৎ আর কেবলের তার ঢেকে রেখেছে দু’পাশের দেওয়াল। এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় একটু বৃষ্টি হলেই জল জমে। এ হেন গলির মধ্যে দামিনীর বাড়ি। দিদির কথা বলছেন দুই ভাই। ছোট জনের বয়স এখন ১৮। বললেন, “সব সময় বলতাম, আমি মহাকাশচারী হব। দিদি কিন্তু ও সব শুনে হেসে উড়িয়ে দিত না। বরং উৎসাহ দিয়ে বলত, তোমার যা ইচ্ছে, তাই করবে। তবে তার জন্য অনেক খাটতে হবে।” সৌরভের এখন আর মহাকাশচারী হতে ইচ্ছে করে না। সে দিদির স্বপ্নটা নিজের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। ডাক্তার হতে চায় সৌরভ।
দামিনীর আসল পরিচয় ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন তাঁর বাবা-মা। কিন্তু ভারতীয় দণ্ডবিধির ২২৮এ ধারায় ধর্ষিতার নাম প্রকাশ করা নিষেধ। “আমরা কেন লজ্জা পাব? আমরা তো কোনও অন্যায় করিনি। যারা অন্যায় করেছে, তাদের লজ্জা পাওয়া উচিত”, ক্ষোভে ফেটে পড়লেন গৌরব। “আমি দেখেছি ওদের কোনও লজ্জা নেই। কোনও অনুতাপ নেই। আদালতে দাঁড়িয়েও ওরা মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকত। বেশরম হ্যায় উহ।” এত দিন ধরে জেলে খাইয়ে-পরিয়ে রাখার অর্থ খুঁজে পাচ্ছেন না দুই ভাই। “আমি কিছু দিন আগেই দেখেছি। খেয়েদেয়ে ভালই ওজন বেড়েছে ওদের।” কিছু ক্ষণ থেমে ফের বললেন, “হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে দিদি যে লড়াইটা শুরু করেছিল, আমরা সেটা শেষ করব। করবই...।”

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.