পেশাদার হাতে নয়, মহাকরণ সংস্কারে ভার পূর্ত দফতরকেই
হাকরণ সংস্কারের কাজে শেষ পর্যন্ত পূর্ত দফতরের উপরেই ভরসা রাখছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এই ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন ভবন সংস্কারের কাজ বিশেষজ্ঞ সংস্থার হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে বিভিন্ন মহল থেকে যে মতামত এসেছে, রাজ্য সরকার কার্যত তা খারিজ করে দিয়েছে। শনিবার মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র স্পষ্ট জানিয়ে দেন, মহাকরণ সংস্কারের কাজে রাজ্য সরকারের পূর্ত দফতরই সক্ষম।
মুখ্যসচিবের কাছে প্রশ্ন ছিল, রাজভবন কিংবা জাদুঘরের মতো ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলির সংস্কার করছে আর্ন্তজাতিক মানের বিশেষজ্ঞ সংস্থা। মহাকরণের ক্ষেত্রে কী হবে? মুখ্যসচিবের যুক্তি, “রাইটার্স বিল্ডিং কোনও ভিআইপি-র বাসস্থান কিংবা মিউজিয়াম নয়। এটা একটা কাজ চলা অফিস বাড়ি। এই বাড়ির হালহকিকত পূর্ত দফতরের সবই জানা। পুরনো নকশাও তাদের হাতে রয়েছে। তাই মহাকরণের মতো একটি অফিস বাড়ি সংস্কার করার জন্য যে পারদর্শিতা বা দক্ষতা প্রয়োজন, তা পূর্ত দফতরের রয়েছে। তারাই এই কাজ করতে সক্ষম। এখনই কোনও বিশেষজ্ঞ সংস্থা লাগানোর প্রয়োজন দেখছি না।” পূর্ত সচিব ইন্দিবর পাণ্ডে বলেন, “বেসু এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থপতিরা একটি ‘কনসেপ্ট পেপার’ তৈরি করে দেবেন। তা আসার পরেই বলতে পারব, কোন পথে এগোবে মহাকরণের সংস্কার এবং সংরক্ষণের কাজ।” আপাতত গঙ্গার ও-পাড়ে এইচআরবিসি ভবনে মহাকরণের অফিস স্থানান্তর করাই যে সরকারের অগ্রাধিকার, প্রশাসনের কর্তাদের কথায় তা স্পষ্ট।
খড়্গপুর আইআইটি-র অধ্যাপক সঙ্ঘমিত্রা বসু বলেন, “কাজ চলা বাড়ির ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ সংস্থা দিয়ে সংস্কারের কাজ করা যায় না, এমনটা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে বছরের সব সময়েই তীর্থযাত্রীদের ভিড় লেগে থাকে। তার মধ্যেই তো ওই মন্দিরের সংস্কার হচ্ছে, বিশেষজ্ঞ সংস্থাকে দিয়েই।” তাঁর মতে, “এর আগে কেউই এ ভাবে রাইটার্স বিল্ডিং সংস্কারের কথা ভাবেননি। ফলে, এই প্রচেষ্টা খুবই প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু এই ধরনের ভবন সংস্কারের দায়িত্ব তাদেরই দেওয়া উচিত, যাদের এ ব্যাপারে পারদর্শিতা এবং দক্ষতা রয়েছে। আসলে, এই কাজের ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা বড় ব্যাপার। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে জবাবদিহির স্বার্থেই স্পষ্ট করা উচিত, কী ভাবে এই সংস্কার করা হচ্ছে, কেনই বা করা হচ্ছে। প্রয়োজনে বিষয়টি জানিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে পারে সরকার।” এ দিনই সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, এই কাজের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে একটি ওয়েবসাইট খোলা হবে। সেখানে সাধারণ মানুষ পরামর্শ দিতেই পারেন।
মহাকরণের মতো ঐতিহ্যবাহী ভবনের সংস্কার নিয়ে সরকার যে পথে এগোচ্ছে, তাতে গোড়াতেই সংশয়ে থাকছেন প্রাচীন ভবন সংরক্ষণে বিশেষজ্ঞেরা। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে সংসদ ভবন, হায়দরাবাদ হাউস দিল্লিতে ব্রিটিশ আমলের একাধিক বাড়ি সংস্কারের গুরুদায়িত্ব সামলানো ঐতিহ্যবাহী ভবন সংস্কার বিশেষজ্ঞ সুনীতা কোহলির মতে, এ ব্যাপারে দু’টি দিক মাথায় রেখে এগোতে হয়। প্রথমত, ঐতিহাসিক স্থাপত্যরীতির মূল বিষয়গুলি অপরিবর্তিত রাখা হয়। দ্বিতীয়ত, ওই ভবনে এখনকার কাজকর্ম চালানোর জন্য কী কী ব্যবস্থা প্রয়োজন, তা দেখা হয়। অর্থাৎ ভবনটির ঐতিহ্য বজায় রেখে তার মূল স্থাপত্যরীতি অক্ষুণ্ণ রাখা এবং তার পাশাপাশি আধুনিক প্রশাসন চালানোর উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা। এবং এই দুই কাজই চূড়ান্ত পেশাদার হাতে হওয়া উচিত বলে জানাচ্ছেন সংস্কার কাজের বিশেষজ্ঞরা। সেই সঙ্গেই দরকার শহরের চরিত্র ও ইতিহাস মাথায় রাখা ও পুরনো মানচিত্র, নথি, ছবি দেখে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আর এই কাজ শুরুর আগেই দরকার পুরোদস্তুর গবেষণার। এ রাজ্যে হেরিটেজ কমিশনের সঙ্গে যুক্ত স্থপতি পার্থ দাসের মতে, “পূর্ত দফতর সংস্কারের কাজ করুক, তাতে অসুবিধে নেই। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েই সংস্কারের কাজ করা উচিত।”
ঐতিহ্যবাহী ভবনের কাজে অন্য চ্যালেঞ্জের কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমস্ত পুরনো নকশা, পরিকল্পনা বা কাঠামো সংক্রান্ত নথি মেলে না। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, এই ধরনের ভবন সংস্কারের আগে পুরোপুরি গবেষণা করে খুব সাবধানে এগোনো উচিত। সঙ্ঘমিত্রাদেবীও বলছেন, “প্রথমেই জোগাড় করতে হবে যাবতীয় নির্মাণ নকশা ও বিভিন্ন সময়ের ছবি। বিশেষজ্ঞেরা তারই ভিত্তিতে তৈরি করবেন সংস্কারের পরিকল্পনা। এ ধরনের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সংস্কারের কাজ না এগোলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।” মহাকরণের এক ইঞ্জিনিয়ারের বক্তব্য, ১৮০০ সাল থেকে মহাকরণের যাবতীয় নকশা তাদের হাতে রয়েছে। মহাকরণকে তাঁদের থেকে ভাল কেউ চেনে না। পূর্ত দফতরের সচিব ইন্দিবর পাণ্ডের দাবি, কনসেপ্ট পেপার পাওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রীর অনুমোদন সাপেক্ষে সংস্কারের কাজ করতে পুরোমাত্রায় তৈরি তাঁরা।
পুরনো বাড়ি সংরক্ষণে বিশেষজ্ঞদের মতে, মহাকরণ সংস্কারের কাজে সরকার কিছুটা তাড়াহুড়ো করে ফেলছে। পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার আগেই অফিস সরিয়ে বাড়ি ভাঙার কাজ শুরু করতে চলেছে পূর্ত দফতর। যা শুনে ভবনটি সংরক্ষণে সরকারের সদিচ্ছা নিয়েই সংশয়ে বিভিন্ন মহল। সরকার কি ঐতিহ্য বজায় রেখে প্রয়োজনমাফিক রাইটার্সের সংস্কার চায়, নাকি অফিস সরিয়ে শুধু এদিক-ওদিক মেরামতে জোর দিচ্ছে, উঠছে সেই প্রশ্নও।
মহাকরণ সংস্কারের খরচ কত হবে, তা নিয়েও ধোঁয়াশা রাখছে সরকার। মুখ্যসচিব জানিয়েছেন, অফিস সরানোর খরচ বিরাট কিছু হবে না। সংশ্লিষ্ট দফতর সেই খরচ বহন করবে। কিন্তু সংস্কারের খরচ কত হবে, তা বলা মুশকিল। তাঁর বক্তব্য, যে অর্থের প্রয়োজন, তা রাজ্য বাজেট থেকে সংস্থান করা হবে। বাইরের সংস্থার সাহায্য প্রয়োজন নেই। সংস্কার কাজে পেশাদারের দ্বারস্থ হওয়ার উদাহরণ অবশ্য এই রাজ্যেই রয়েছে। যেমন রাজভবন। প্রাথমিক ভাবে এ রাজ্যের বিশেষজ্ঞ স্থপতিদের নিয়ে একটি কমিটি গড়ে দেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন। সেই কমিটির তত্ত্বাবধানে তিনটি পেশাদার সংস্থাকে বাছাই করে তাদের রাজভবনে আসতে বলা হয়। তার পরে সব দিক বিচার করে মুম্বইয়ের একটি পেশাদার স্থপতি সংস্থাকে রাজভবনের সংস্কারের ভার তুলে দিয়েছেন রাজ্যপাল। ওই সংস্থা এর আগে মুম্বইয়ের ছত্রপতি শিবাজী মিউজিয়ামের সংস্কার করেছে। দু’শো বছরে পা-দেওয়া ভারতীয় জাদুঘরের সংস্কারের কাজ তদারকিতেও ডাকা হয়েছে এক ব্রিটিশ সংস্থাকে। এই কাজের মূল বরাত পাওয়া ন্যাশনাল বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানির (এনবিসিসি) এক কর্তার কথায়, “ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতি মেনেই জাদুঘর তৈরি হয়েছিল। সেই কারণে তার সংরক্ষণ ও সংস্কারের কাজ তদারক করতে ব্রিটিশ সংস্থাকে ডাকা হয়েছে। যাদের এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে।”
দেশের অন্যত্র এই ধরনের ঐতিহ্যবাহী ভবনের সংস্কারের কাজ যে ভাবে হয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকারও সেই পথ নিতে পারে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। তাদের মতে, সরকারি নিয়মনীতিতে আটকে থেকে সংস্কারের কাজ করতে গেলে কাঙ্ক্ষিত ফল তো মিলবেই না, উল্টে বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকে যাবে। যথেষ্ট দক্ষতাহীন সরকারি সংস্থাকে দিয়ে কাজ করানোর ফলে উল্টোডাঙা উড়ালপুলে বিপর্যয় নেমে এসেছিল। সংস্কারের সাহসী পদক্ষেপ নিয়েও শেষ পর্যন্ত এমন কোনও বিপর্যয়ের মুখে মহাকরণকে পড়তে হবে কি না, তা অবশ্য সময়ই বলবে।

সংস্কার ও সরকার
মহাকরণ সংস্কার কী কারণে? নতুন রূপ দেওয়া, না সংরক্ষণ?
দু’টোই। মহাকরণের নকশা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের। এই গ্রিকো-রোমান স্থাপত্যের নির্দশন পূর্ণতা পায় উনিশ শতকের শেষে। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে সাযুজ্যহীন সংযোজন, পরিবর্তন হয়েছে। ফলে বার বার আগুন লেগেছে। সমস্যা রয়েছে আলো-বাতাস চলাচল, পরিবেশ, পানীয় জল, নিকাশি নিয়েও। ঐতিহ্য ও স্থাপত্য বজায় রেখে সংস্কার জরুরি।
শুধু কি বাইরের চেহারা বদলাবে?
বিভিন্ন সময় সংযোজন করতে গিয়ে ঐতিহ্যবাহী চরিত্রের যে ক্ষতি হয়েছে, তা ফেরানো হবে।
সরকার কী ভাবে প্রকল্প রূপায়ণ করবে?
পূর্ত দফতরই বরাবর মহাকরণ-সহ সব সরকারি ভবন রক্ষণাবেক্ষণ করেছে। বেসু ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে এ বারও কাজ করবে তারাই।
বাইরের পরামর্শ নেওয়া হবে?
সব পরামর্শই স্বাগত। একটি ওয়েবসাইটও খোলা হচ্ছে।
কোনও বিষয়কে কি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে?
মহাফেজখানা ও পাঠাগারে এখনই হাত দেওয়া হবে না। যে সব দফতর মহাকরণে থেকে যাবে, তাদের কর্মীদের পেনশন ও চাকরি সংক্রান্ত নথি সংরক্ষিত হবে।
কোন কোন দফতর, কীসের ভিত্তিতে সরছে?
মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্র, অর্থ, পূর্ত, তথ্য ও সম্প্রচার, কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার, বিপর্যয় মোকাবিলা, ভূমি ও ভূমি সংস্কার, সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা এবং কৃষি দফতর সরে যাচ্ছে। এই দফতরগুলির সঙ্গে জনসাধারণের সরাসরি যোগাযোগ। পরিবহণ দফতর সরে গিয়েছে। পর্যটন ও ক্ষুদ্র শিল্প দফতরও অন্য ভবনে উঠে যাচ্ছে।
নতুন ভবনে যাতায়াতের ব্যবস্থা?
শুরুতে কিছু সমস্যা মানিয়ে নিতে হয়। যাতায়াতের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করার চেষ্টা হচ্ছে।
দফতর না সরিয়ে সংস্কার করা যেত না?
সংস্কার করতে পর্যায় ক্রমে দফতর স্থানান্তর করার সুপারিশ করেছিল পূর্বতন মুখ্যসচিবের কমিটি। তাতে সময়ে কাজ শেষ করা কঠিন হত।
সংস্কারে খরচ কত?
পরিকল্পনা চূড়ান্ত হলে খরচ ঠিক হবে।
অন্তর্বর্তী স্থানান্তরের ব্যয় কি বাজে খরচ নয়?
না, হাওড়ার নতুন পরিকাঠামো পরেও ব্যবহার হবে।

পুরনো খবর:
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.