নেমন্তন্ন করে গিয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েল। আমন্ত্রণ এসেছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, শিকাগো ধর্মসম্মেলন থেকেও। কিন্তু এখনই মার্কিন মুলুকে যাচ্ছেন না মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও ডাক পেয়েছিলেন আমেরিকা থেকে। আমন্ত্রিত ছিলেন তাঁর শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনও। কিন্তু দলের মার্কিন-বিরোধী নীতির জন্য দু’জনের কেউই যাননি। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত অবশ্য এমআইটি-তে বক্তৃতা দিতে গিয়ে অনাবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন (অসীমবাবু এমআইটি-র প্রাক্তন ছাত্র)। তৃণমূলের আমেরিকা নিয়ে এমন কোনও ছুঁৎমার্গ নেই। মমতা নিজেই সে কথা জানিয়েছেন। কেন তিনি এখনই আমেরিকা যাবেন না, সে প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সফর নিয়ে আমার কোনও ছুঁৎমার্গ নেই। কিন্তু এখন রাজ্যে অনেক কাজ।” তিনি অগ্রাধিকার দিয়েছেন রাজ্যে শিল্পায়ন প্রক্রিয়াকে। মমতা বলেন, “এখন থেকেই পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়ন এবং উন্নয়নের কাজ বাস্তবায়িত করতে হবে। গত দু’বছর ধরে আমরা অনেক কাজ করেছি। এ বার তা ফল দিতে শুরু করবে। আগে রাজ্যের শিল্পায়ন এবং উন্নয়নে সঠিক পরিকাঠামো তৈরি হোক। তার পর সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবের ভিত্তিতে আমি মার্কিন সফরে যাব।” এই কাজের সঙ্গে রয়েছে পরপর ভোট। মমতা জানিয়েছেন, সামনেই ১২টি পুরসভায় নির্বাচন। তার পরে এসে যাবে লোকসভা নির্বাচন। ২০১৫ সালে কলকাতা পুরভোট।
মার্কিন দূতাবাস সূত্র বলছে, মমতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য কোনও ভিসার আবেদনও করেননি। শুধু তাই নয়, তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ ডেরেক ওব্রায়েনও এ দিন টুইটারে জানিয়েছেন, মমতা এ বছর আমেরিকা যাচ্ছেন না। যদিও আগামী নভেম্বরেই শিকাগোয় স্বামী বিবেকানন্দের জন্মের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে ‘শিকাগো কলিং’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সেই অনুষ্ঠানে বেলুড় মঠের সাধারণ সম্পাদক স্বামী সুহিতানন্দ এবং সহকারী সম্পাদক স্বামী শুভকরানন্দও যাচ্ছেন। এ ছাড়া হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য বহু দিন ধরেই তাঁর কাছে আমন্ত্রণ রয়েছে। রাখী পূর্ণিমার দিন সুগত বসুও তাঁর সঙ্গে দেখা করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
কিন্তু মুম্বই শিল্প সম্মেলনে সাফল্য এবং তার পরপরই রিলায়্যান্স-সহ একাধিক প্রকল্প নিয়ে তৎপরতা শুরু হওয়ার পরে মমতা চাইছেন, সেই সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবগুলি কী ভাবে পূরণ করা হবে, তা আগে চূড়ান্ত করা হোক। এই কাজটা তিনি নিজেই দেখভাল করতে চাইছেন। তার পর ২০১৪ সালের গোড়ার দিকে সব দিক বিবেচনা করে তিনি আমেরিকা যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।
প্রশাসন সূত্রের খবর, মুম্বই শিল্প সম্মেলনের পরে রাজ্যে শিল্পায়নের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশিকা তৈরি করতে চান মুখ্যমন্ত্রী। পঞ্চায়েত ভোট পর্যন্ত গ্রামীণ বাংলা এবং তার বিস্তৃত কৃষক সমাজকে অগ্রাধিকার দিচ্ছিলেন তিনি। এখন পঞ্চায়েতের ভোটের পর থেকেই তিনি শিল্পায়ন এবং ভারী শিল্প গঠনের প্রয়োজনীয়তার দিকে মন দিচ্ছেন। মুম্বই বৈঠকের পরেই রিলায়্যান্সের ফোর জি প্রকল্পে ছাড়পত্র দিয়েছে রাজ্য। এর মধ্যে হলদিয়া পেট্রোকেম নিয়েও উৎসাহ দেখাচ্ছেন মুকেশ অম্বানী। এ ছাড়া গ্যাস অথরিটি এবং ইন্ডিয়ান অয়েলও নিলামে অংশ নিচ্ছে। যাতে হলদিয়া পেট্রোকেমের ভবিষ্যৎ নিয়ে সুষ্ঠু ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়, সে জন্যও মমতা সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছেন। এ ছাড়াও রয়েছে অসমাপ্ত প্রকল্পগুলি। যেমন, জিন্দলদের ইস্পাত প্রকল্প, পরিবেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্র না পাওয়ায় আটকে যাওয়া প্রসূন মুখোপাধ্যায়ের নয়াচর প্রকল্প। অন্ডালের বিমানবন্দরে পবন হংসের হেলিকপ্টার চললেও বিমান পরিষেবা কবে চালু হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এই কাজগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমলা ও শিল্পপতি, দুই মহলকেই জোর ঠেলা দিতে হবে। মমতা কলকাতায় উপস্থিত থেকে সেই ঠেলা দেওয়ার কাজটাই নিরবচ্ছিন্ন ভাবে করতে চাইছেন।
শিল্পমহলকে আশ্বস্ত করতে মুখ্যমন্ত্রী আবার বলেছেন, “জমি অধিগ্রহণে শিল্পপতিদের কোনও সমস্যা হবে না।” কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “গণতন্ত্রে ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালান্সের’ প্রয়োজন হয়। চাষিদের কাছ থেকে জোর করে জমি না নিয়ে বরং যাঁরা স্বেচ্ছায় জমি দেবেন, এমন কৃষকদের থেকে ব্যবসায়ীরা সরাসরি জমি কিনতেই পারেন।” তিনি জানিয়েছেন, “ইতিমধ্যে আমরা গ্রামীণ বাংলায় বহু জমি কেস-টু-কেস সমীক্ষা করে মন্ত্রিসভার ছাড়পত্র দিয়েছি।” রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল, শ্রমদিবস অনেক কম নষ্ট হচ্ছে এই যুক্তি তুলে তাঁর আশা, সবার সঙ্গে পরামশর্র্ করে এগোলে রাজ্য ফের শিল্পমুখী হবে।
মুখ্যমন্ত্রী বললেও কিছু বিষয়ে শিল্পমহলের প্রশ্ন কিন্তু রয়েই গিয়েছে। প্রথমত, মমতার সরকার যে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করবে না, সেটা তাঁর আশ্বাসের পরেও স্পষ্ট। শিল্পমহলের প্রশ্ন, যে রাজ্যে জমি বহু মালিকানায় বিভক্ত, সেই পশ্চিমবঙ্গে চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি জমি কিনে কী ভাবে শিল্প গড়া সম্ভব? দ্বিতীয়ত, শিল্পমহল অনেক দিন ধরেই জমির ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়ার কথা বলে আসছে। এখনও সেই বিষয়ে বড় পদক্ষেপ হয়নি। সে ক্ষেত্রে এক লপ্তে অনেকটা জমি কেনা যাবেই বা কী ভাবে? তৃতীয়ত, মমতা বরাবর দাবি করেছেন, রাজ্যের জমি-ব্যাঙ্ক তৈরি। কিন্তু বাস্তব হল, তাতে কাজের জমি বিশেষ নেই। বেশির ভাগই সেচ দফতরের জমি, যা লম্বাটে। এই জমিতে শিল্প হওয়া নিয়েও সংশয় রয়েছে কোনও কোনও শিল্পপতির মনে। সর্বোপরি, রাজ্যের শিল্পনীতিও স্পষ্ট নয়। এই প্রশ্নগুলির যথাযথ জবাব দিয়ে শিল্পপতিদের রাজ্যে টেনে আনা কতটা সম্ভব, তা নিয়ে সংশয় থাকছেই একটি মহলে। তবে অন্যদের বক্তব্য, মুম্বই শিল্প সম্মেলনের পরে যে ভাবে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিটি বিষয়ে জট ছাড়ানোর চেষ্টা চলছে এবং মুখ্যমন্ত্রী যে ইতিবাচক ভূমিকা নিচ্ছেন, তাতে আশা রাখা যেতেই পারে। |