২৫২ থেকে ৭৮০। পশ্চিমবঙ্গে ছোট শহরের (সেনসাস টাউন) সংখ্যা গত দশ বছরে বেড়েছে ৫২৮টি। অথচ, এই দশ বছরে পুরসভায় উন্নীত হয়েছে মাত্র ছ’টি এলাকা।
জনগণনার এই পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট, শহুরে জনসংখ্যার একটা বড় অংশ আজও নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য থেকে বঞ্চিত। পরিকাঠামোর দিক দিয়ে অধিকাংশ এলাকা গ্রামীণ হওয়ায় পানীয় জল, বিদ্যুৎ, শৌচালয় ও নিকাশির মতো পরিকাঠামোতে সামগ্রিক ভাবে পিছিয়েই রাজ্য।
কমপক্ষে ৫,০০০ জনসংখ্যা বিশিষ্ট কোনও এলাকায় জনঘনত্ব প্রতি কিলোমিটারে চারশোর বেশি হলে এবং জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ লোক কৃষিকাজ ছাড়া অন্য কোনও পেশায় যুক্ত থাকলে আমাদের দেশের জনগণনায় তাকে শহর বলে বিবেচনা করা হয়। বাস্তবে ওই এলাকাটি পঞ্চায়েতের আওতায় থাকলে ‘সেনসাস টাউন’ বলে। ভারতে সেনসাস টাউনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি পশ্চিমবঙ্গে, পিছনেই রয়েছে কেরল, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ।
জনগণনায় আরও দেখা যাচ্ছে, শহুরে জনসংখ্যার মধ্যে কলকাতার ভাগ কমছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জেলার ছোট-মাঝারি শহরগুলির আয়তন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় কলকাতায় কষ্ট করে (মেসে বা একচিলতে ভাড়া বাড়িতে) না থেকে আজকাল হাওড়া বা দুই ২৪ পরগনার শহরতলি এমনকী, নদিয়া, বর্ধমান থেকে যাতায়াত করছেন লোকজন। এ ছাড়া, দূরের জেলাগুলিতে আলাদা করে বাজার কেন্দ্রিক বা পরিষেবা নির্ভর শহর গড়ে উঠছে। কিন্তু এই সব ‘সেনসাস টাউনে’ সন্ধে নামলেই রাস্তাঘাট অন্ধকারে ডুবে যায়। সামান্য বর্ষাতেই জল জমে। যেখানে-সেখানে জঞ্জাল। |
যেমন, বর্ধমান জেলার বাজার কেন্দ্রিক শহর পানাগড় এখনও পঞ্চায়েতে পড়ে আছে। পুরনো গাড়ি কেনাবেচার জন্য বিখ্যাত পানাগড়ে জামাকাপড় থেকে শুরু করে ইমারতি সামগ্রীকিসের দোকান নেই? বিশাল এই বাজার সরানো নিয়ে ঝামেলার জেরেই আটকে আছে ২ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কাজ। পুরসভা হলে উন্নয়নের বিভিন্ন খাত থেকে যে টাকা পাওয়া যেত, তাতে অন্যত্র ‘শপিং কমপ্লেক্স’ বানিয়ে সমস্যা মেটানো যেত হয়তো। পঞ্চায়েতের সে ক্ষমতা নেই। পানীয়, নিকাশির মতো নাগরিক পরিষেবাগুলিতেও পিছিয়ে পানাগড়। রাস্তাঘাট অধিকাংশ পাকা হলেও পথবাতি নেই। একশো দিনের কাজে সম্প্রতি কিছু এলাকায় নিকাশিনালা তৈরি হলেও তা যথেষ্ট নয়। জনস্বাস্থ্য দফতরের পানীয় জলের সংযোগ শুধু রাস্তার ধারে। বাড়ি-বাড়ি পানীয় জল পৌঁছনো বহু দূর। বর্ধমানেরই আর এক শহুরে বসতি অন্ডালে রয়েছে প্রচুর স্কুল, রেলের হাসপাতাল। কিন্তু পঞ্চায়েত বলে রাস্তাঘাট বেহাল। নিকাশি, আবর্জনা সাফাইয়ের বন্দোবস্ত নেই।
কলকাতার কাছে হাওড়া জেলার আন্দুলেও একই ছবি। গত এক দশকে হাওড়া জেলায় শহুরে জনসংখ্যা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। অথচ, এই জেলায় আশির দশকের পরে কোনও শহর পুরসভায় উন্নীত হয়নি। বাগনান, আন্দুল, ডোমজুড়, সাঁকরাইলঝুলে থাকার তালিকাটা দীর্ঘ। আন্দুলের অধিকাংশ বাসিন্দাই চাকুরিজীবী। গত এক দশকে জনসংখ্যা বেড়েছে লাফিয়ে-লাফিয়ে। পুরসভা হলে বসতি গড়ে উঠত পরিকল্পিত ভাবে। পঞ্চায়েত বলে এই সব নিয়ম-কানুন দেখার কেউ নেই। গায়ে-গায়ে ফ্ল্যাট বাড়ি উঠে গিয়েছে। মাঝে নিকাশি জল বেরনোর জায়গাটুকুও নেই অনেক বাড়িতে। রাস্তাঘাট পাকা হলেও পথবাতি নেই। ব্যক্তিগত ভাবে বাড়ির সামনে আলোর ব্যবস্থা করে রেখেছেন লোকজন। তাতেই যতটুকু হয়। ময়লা আবর্জনা ফেলার বন্দোবস্ত নেই। কেউ বাগানে ময়লা ফেলেন তো কেউ বাড়ির পরিচারিকাকে দিয়ে দূরে ময়লা ফেলতে পাঠান। ব্লক তৃণমূল সভাপতি তুষার ঘোষ বলেন, “পঞ্চায়েতে আর কত টাকা আসে, যে ভ্যাট তৈরি বা সাফইকর্মী নিয়োগ করবে। ঝোড়হাট, আন্দুল, মহিয়াড়ী ১ ও ২, বানীপুর ২, মাশিল্যা পঞ্চায়েতগুলিকে নিয়ে পুরসভা গঠনের প্রস্তাব উঠেছে বহু বার। কেন হচ্ছে না জানি না।”
নিয়ম অনুযায়ী, প্রাথমিক ভাবে পুরসভা করার প্রস্তাব স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তোলার কথা। প্রশাসনের কর্তাদের একটা বড় অংশের অভিজ্ঞতা, সবচেয়ে বড় বাধা আসে এই প্রথম ধাপেই। রাজনীতির সমীকরণে পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা, পাঁশকুড়া পুরসভা হলেও কোলাঘাট, মহিষাদল থেকে যায় পঞ্চায়েতে।
নেতাদের পাল্টা যুক্তি, পুরসভা হলে বিভিন্ন নিয়মকাননুন যেমন কঠোর হয়, তেমনই কর বাড়ে। ফলে, বাসিন্দাদের মধ্যে পঞ্চায়েতের আওতা থেকে বেরোনোর ক্ষেত্রে অনীহা কাজ করে। যদিও এই যুক্তি মনগড়া বলে দাবি বেশিরভাগ বাসিন্দার। বাঁকুড়ার খাতড়া মহকুমা সদরের বাসিন্দারা যেমন দীর্ঘ দিন ধরেই পুরসভার দাবি জানিয়ে আসছেন। তাঁদের অভিযোগ, প্রশাসনিক গড়িমসিতে নথিপত্র আটকে রয়েছে লাল-সুতোর গেরোয়। এসডিও (খাতড়া) শুভেন্দু বসু অবশ্য বলেন, “২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে খাতড়া ১, ২, ধানাড়া ও সুপুর পঞ্চায়েতের ১৪টি মৌজাকে নিয়ে পুরসভা গঠনের প্রস্তাব পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরে। ওই প্রস্তাব কী অবস্থায় রয়েছে জানি না।”
আটকাচ্ছে কোথায়?
পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, “মূল কারণটা অর্থাভাব। কোনও এলাকাকে পুরসভায় উন্নীত করতে হলে যেমন বিশদ তথ্য-সমীক্ষা লাগে, তেমনই পরিকাঠামো তৈরির জন্য প্রচুর টাকা লাগে। রাজ্যের কোষাগারের যা হাল, তাতে বাড়তি বোঝা এই মুহূর্তে বওয়া সম্ভব নয়।” রাজ্যের পুরসচিব ভগবতীপ্রসাদ গোপালিকাও বলেছেন, “এখনই কোনও পুরসভা উন্নীতকরণের ভাবনা নেই রাজ্য সরকারের।” |