|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
লেখ্যাগারের উদ্যোগ আশা জাগায় |
কলকাতার ইতিহাস নিয়ে শ’য়ে শ’য়ে বই থাকলেও, তার সার-সংক্ষেপ পাঁচ খণ্ড পেরোবে কিনা সন্দেহ। আসলে কলকাতার অতীত চর্চায় আকরসূত্র এত কম ব্যবহৃত হয়েছে যে চর্বিতচর্বণ হয়ে পড়েছে বাধ্যতামূলক। এ দেশে কাগজের আয়ু সীমিত। পুরনো পারিবারিক নথিকে বাঙালি আবর্জনা মনে করে, পুরনো সংবাদপত্র দুষ্প্রাপ্য। সেই কোন কালে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিনয় ঘোষ-রা সংবাদ-সংকলনে ব্রতী হয়েছিলেন। ইদানীং স্বপন বসু সচেষ্ট হলেও কলকাতার নাগরিক ইতিহাস তাঁর কৃপাদৃষ্টি পায়নি, হরিপদ ভৌমিকের সে কালের সংবাদপত্রে কলকাতা দু’টি খণ্ডের পর থমকে গেছে সিকি শতাব্দী আগে।
প্রাতিষ্ঠানিক সংগ্রহগুলির অবস্থাও করুণ। হাইকোর্টের মহাফেজখানা কলকাতার ঐতিহাসিক উপকরণের রত্নভাণ্ডার, কিন্তু সেখানে ঢোকার ‘চিচিং ফাঁক’ মন্ত্র ক’জন গবেষক-আলিবাবা আওড়াতে পেরেছেন? দেড়শো বছর আগের সুপ্রিম কোর্ট রেকর্ডস আজ আর কারও আইনি প্রয়োজনে লাগার কথা নয়— একই কথা প্রযোজ্য শতাধিক বছরের পুরনো মামলার তথ্য সম্পর্কেও। সেগুলি কোনও লেখ্যাগারে পাঠিয়ে দিলে উপকৃত হতেন ইতিহাস রচয়িতারা। অবশ্য এমনটাও হলফ করে বলা মুশকিল। কয়েক যুগ ধরে লটারি কমিটির রিপোর্ট ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে ধার দিয়ে রেখেছে পুরসভা, হাইকোর্ট দিয়ে রেখেছে বহু অজানিত তথ্যে ঠাসা বিচারক হাইড-এর নোটস। এর কোনওটাই আজও আলোর মুখ দেখেনি। পুরসভার নথিঘর সুবিন্যস্ত করলে ঐতিহাসিকরা ব্যবহার করতে পারতেন, নির্বাচিত অংশ ‘কলকাতা পুরশ্রী’র পাতায় প্রকাশ করা যেত অক্লেশে। সমৃদ্ধ হত কলকাতার ইতিহাস রচনার ঘরানা।
সরকারি লেখ্যাগারের উদ্যোগ তুলনামূলক ভাবে আশাপ্রদ। প্রদর্শনীর সময় তাঁরা নিয়মিত চয়ন-পুস্তিকা প্রকাশ করেন, ১৯৯০-এ বেরিয়েছিল কলকাতা বিষয়ক সংকলনগ্রন্থ। সেটিরই অনুসারী খণ্ড সিলেক্ট ডকুমেন্টস অন ক্যালকাটা: ১৮০০-১৯০০ (রাজ্য লেখ্যাগার, ১৮০০.০০)। অতীশ দাশগুপ্ত ও প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকা সংবলিত বইটির তিনটি অংশে শহরের বিস্তার ও সমন্বয়, পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ও প্রশাসনিক বিবর্তন সংক্রান্ত বাছাই নথি স্থান পেয়েছে। বিভাগগুলির স্বতন্ত্র উপক্রমণিকা লিখেছেন সংকলকদ্বয় বিদিশা চক্রবর্তী ও শর্মিষ্ঠা দে। অঢেল অদেখা সম্পদ নাগালে এনে দিয়েছে ৫২৮ পাতার বইটি। গোড়ায় পরিভাষার ফর্দও আছে, কিন্তু তাতে গোঁসাইদের ‘কনভেন্ট’-এ থাকার উল্লেখ বা মড়াফেলা ‘মুর্দাফরাশ’-দের ‘সুইপার’ বলাটা কি যৌক্তিক? নথি-নির্বাচন প্রক্রিয়ারও ব্যাখ্যা প্রয়োজন ছিল। ওয়েলেসলির যে ‘মিনিটস’ দিয়ে কলকাতা নগরায়ণের প্রকৃত সূত্রপাত, তা এ বইতে নেই, নেই ফিভার হসপিটাল কমিটির মূল্যবান রিপোর্টের কোনও প্রত্যক্ষ প্রতিফলন। কর্তৃপক্ষের মনে যদি খণ্ডক্রমে আরও এগোনোর বাসনা থাকে, সে পরিকল্পনা প্রথমে ঘোষিত থাকলে পাঠকের আশাভঙ্গের বেদনা লাঘব হত। বিশেষ পাতায় মুদ্রিত হয়েছে আলোকচিত্র, মানচিত্র এবং রণবীর রায়চৌধুরীর গ্লিম্পসেস অব ওল্ড ক্যালকাটা থেকে পনেরো পাতা জোড়া উদ্ধৃতি। মূল নথির সংকলনে মূল সংবাদপত্র উদ্ধৃত করাটাই বাঞ্ছনীয় ছিল না কি?
এই দুই সংকলক লেখ্যাগারের নথিভিত্তিক একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধ সংকলনও রচনা করেছেন (ক্যালকাটা ইন দ্য নাইনটিনথ সেঞ্চুরি: অ্যান আর্কাইভাল এক্সপ্লোরেশন, নিয়োগী বুকস, ৫৯৫.০০)। পঞ্চাশটি সংক্ষিপ্ত নিবন্ধের অর্ধেক বিদিশার, অর্ধেক শর্মিষ্ঠার, মুখবন্ধ পূর্বোক্ত রণবীর রায়চৌধুরীর। অধ্যায়গুলি বিন্যস্ত হয়েছে ছ’টি গুচ্ছে: নগর-প্রশাসন, নাগরিক নিয়ন্ত্রণ, স্থানিক বিস্তার, নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার, নগরায়ণের অভিজ্ঞান। লটারি, কর-ব্যবস্থা, দেশজ উৎসব থেকে শ্বেতাঙ্গিনী যৌনকর্মীদের বিষয় এসেছে প্রসঙ্গক্রমে। তথ্য অনেক, তবে সব ছবির মুদ্রণমান সমান নয়, আর লেখ্যাগার থেকে গৃহীত মানচিত্রে মানচিত্রকারের উল্লেখ না থাকাটা বিভ্রান্তিকর। |
|
|
|
|
|