|
|
|
|
|
|
 |
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
অবহেলিত সূত্রে আলো পড়ল |
দেবাশিস বসু |
প্ল্যানিং দ্য সিটি/ আরবানাইজেশন অ্যান্ড রিফর্ম ইন ক্যালকাটা:
সি. ১৮০০-সি. ১৯৪০,
পার্থ দত্ত। তুলিকা বুকস, ৬৫০.০০ |
কলকাতার ইতিহাস-চর্চা শুরু হয় ইংরেজি ভাষার হাত ধরে। কেবল লং-কটন-ফার্মিংগার নয়, অতুলকৃষ্ণ রায়, বিনয়কৃষ্ণ দেবের মতো বাঙালি পথিকৃৎদেরও বাহন ছিল ইংরেজি। এ পথে নব্য ধারার সূত্রপাত ১৯৭৭ থেকে, সৌম্যেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ক্যালকাটা: মিথস অ্যান্ড হিস্টরি দিয়ে। তার পর প্রদীপ সিংহ থেকে সৌমিত্র শ্রীমানী অনেকেই মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেছেন, নানা দিকে আলো ফেলেছেন এ এইচ কিদোয়াই, মণিমঞ্জরী মিত্র, শমিতা গুপ্ত-রা। স্বাতী চট্টোপাধ্যায়ের রিপ্রেজেন্টিং ক্যালকাটা (২০০৫) যেমন ভূমি ব্যবহার ও গৃহ কল্পনার নিরিখে বিভিন্ন জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজেছে, পার্থ দত্তর আলোচ্য বইটি তেমনই আতসকাচের আদলে অনুপুঙ্ক্ষ ভাবে দেখতে চেয়েছে ১৮০০-১৯৪০ কালপর্বে কলকাতার নগরায়ণ, পরিকল্পনা ও সংস্কারের প্রয়াসগুলিকে, বুঝতে চেয়েছে প্রশাসকদের প্রকল্পের সঙ্গে অধিবাসীদের অবস্থার টানাপড়েন।
স্বীকৃতি, প্রাককথন ও উপসংহার (পরিকল্পনার সংকট) বাদ দিলে বইটিতে ছ’টি অধ্যায়। প্রথম অধ্যায়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে উন্নয়নের উদ্দেশ্য, প্রাপক এবং অভিমুখ ঘিরে। দু’শো বছর আগে রোগভোগের জনক হিসেবে ‘নন্দঘোষ’ ভাবা হত পূতিবাষ্পকে। বায়ুশোধনের জন্য গৃহীত হয় নানা পাশ্চাত্যধর্মী কর্মসূচি, তার খরচ তোলার ব্যবস্থা হয়েছিল লটারি থেকে। আজ যেমন ‘গ্রিনহাউস এফেক্ট’-এর দায় সাহেবরা তৃতীয় বিশ্বের কাঁধে চাপান, সে দিনও শ্বেতাঙ্গরা বায়ুদূষণের অপরাধে কাঠগড়ায় এনেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষদের। দ্বিতীয় অধ্যায়ে তারই বিশ্লেষণ। জ্বরের ভয় থেকে উৎসারিত সরকারি সংস্কারের উদ্যোগ (১৮৩০-’৪০) তৃতীয় অধ্যায়ের উপজীব্য। নিম্নবর্গের ওপর জোর নজর পড়েছে চতুর্থ অধ্যায়ে, এসেছে বস্তি-সংস্কার ও উচ্ছেদের প্রসঙ্গ (১৮৩০-’৯০), প্রান্তিক নাগরিকদের উপর উন্নয়নকামী কর্মকাণ্ডের প্রভাব। পঞ্চম অধ্যায়ে আছে শহরতলি, প্লেগের মড়ক, ও ক্যালকাটা বিল্ডিং কমিশন। শেষ পরিচ্ছেদে এসেছে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন— ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের (সিআইটি) কাজকর্মের (১৯১১-৪০) বিশ্লেষণ। স্বাজাত্যবোধ ও উন্নাসিকতা সত্ত্বেও ব্রিটিশরা যে কত অঙ্ক কষে ক্ষমতার ‘শ্যাম’ আর উন্নয়নের ‘কুল’ বজায় রাখতেন, তার বিশদ পরিচয় আছে এ বইতে।
পরিশ্রম ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ দিতে গবেষণাপত্রে ভূরিভূরি উদ্ধৃতি হাজির করাটাই রেওয়াজ। কিন্তু বইয়ে তাকে টীকায় ঠেলে দিয়ে, নিজস্ব মতামতকে আপন ভাষার রথে বসানোই শ্রেয়। এ গ্রন্থে উদ্ধৃতিবাহুল্য দৃষ্টিকটু লাগে, স্থানবিশেষে তা অপ্রযুক্তও বটে। স্পায়রো কোস্তভ যতই বলুন না যে ‘ক্ষমতাই নগরের চেহারা এঁকে দেয়, আর ক্ষমতার নগ্নতম রূপ নিহিত থাকে শহরের ভূমি-নিয়ন্ত্রণের মধ্যে’ (পৃ ২), সে কথা কি অলিগলির ক্ষেত্রে মানা যাবে? তা হলে ওয়েলেসলির মিনিটের বত্রিশ বছর পরেও এমা রবার্টস কেন ‘ব্ল্যাক টাউন’-এর ‘জঘন্য’ পরিসরে দেখতে পান ‘কল্পনাতীত নোংরা, ঘিঞ্জি, কুনির্মিত, ভিখারিবহুল, দুর্গন্ধময়’ জনবসতি (পৃ ২১)? জ্যামিতিক সৌন্দর্যের খাতিরে জনাকীর্ণ পাড়াকে তছনছ করে রাস্তা তৈরি হত, মামফোর্ডকে শিরোধার্য করে এমন সিদ্ধান্ত টেনেছেন লেখক (পৃ ২২, ৫৩)। কিন্তু শক-এর মানচিত্র দেখলে কি মনে হয় যে লটারি কমিটি গৃহবহুল অঞ্চল ভেদ করে পথ টেনেছিল? লেখক নিজেই তো হেদুয়া থেকে শ্যামপুকুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডকে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেও জনবিরল বলেছেন (পৃ ৪৭)। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের জন্য হ্যালিডে স্ট্রিটকে ব্যবহার করে ভাঙচুরের ব্যাপকতা কমানো হয়। ক্ষতিপূরণের বহর সামলানোর এমন সচেতন চেষ্টা যে ছিল, তা বিল্ডিং কমিশনের ক্ষেত্রে পার্থ স্বীকারও করেছেন (পৃ ১৮৮)। কোমারফদের মতাবলম্বী হয়ে পার্থ নদীঘাট ও পুকুর পাড়ে গুডিভ চক্রবর্তীর নজরদারির প্রস্তাবকে পাশ্চাত্য প্রভাব ভেবেছেন (পৃ ১১২)। কিন্তু জলাশয় দূষণ এড়াতে জমিদারদের পাইক পাঠানোর প্রসঙ্গ তো শ্রীরামকৃষ্ণের বলা চাপরাশের গল্পেও আছে। সেটা বিলেতি আমদানি না দেশজ উপকথা?
ব্যবহারিক এ রকম কিছু গণ্ডগোল থাকলেও বইটির উৎসপঞ্জি নিঃসন্দেহে শ্রমের পরিচায়ক, সম্ভ্রম জাগায়। বহুলাংশে অবহেলিত তিনটি আকরসূত্র লেখক সযত্নে ব্যবহার করেছেন— লটারি কমিটির কার্যবিবরণী (‘রিপোর্ট’ নয়, ‘প্রসিডিংস’), ফিভার হসপিটাল কমিটির রিপোর্ট এবং সিআইটি-র প্রতিবেদনসমূহ। ফলে অজানা তথ্যের আলোয় তাঁর তত্ত্বরচনার পথ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। উৎস নির্দেশের সঙ্গে পার্থ বহু ক্ষেত্রে যোগ করেছেন নানা মন্তব্য, সব ক্ষেত্রে তা মনোযোগী নয়। |

গ্রে স্ট্রিট মোড় থেকে উত্তর দিকে সদ্যনির্মিত সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-র দৃশ্য।
‘লালমন্দির’ নতুন করে তৈরি করে দিয়েছিল সিআইটি, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের
নকশায়।
সিআইটি বার্ষিক রিপোর্ট (১৯৩৭)। |
রাধারমণ মিত্রের কলিকাতা-দর্পণ কি ‘পাড়াগুলির ইতিহাস ও গাইড’ (পৃ ৭)? আপার সার্কুলার রোড নয়, রাধারমণ নাকচ করেছিলেন আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে রামমোহনের বসবাসের দাবি (পৃ ৮৭)। পি টি নায়ারের ভ্রান্তিবহুল আ হিস্টরি অব ক্যালকাটা’স স্ট্রিটস-কে পার্থ ‘মনুমেন্টাল’ বলেছেন। ইংরেজি সূত্র লেখক ভালই দেখেছেন, কিন্তু বাংলা? প্রাণকৃষ্ণ দত্তর কলিকাতার ইতিবৃত্ত বা মহেন্দ্রনাথ দত্তর কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথার সাহায্য নিলে লেখক উপকৃত হতেন। উন্নয়নের দায়ে বারংবার উৎখাত হওয়া আইচ পরিবারের কথা প্রাণকৃষ্ণ লিখেছেন, দিয়েছেন কুমুদকৃষ্ণ মিত্রর পুরসভাকে ‘সুশিক্ষা’ দেওয়া বা ক্ষেত্রমোহন ঘোষের ব্যঙ্গময় প্রতিবাদের বিবরণ। অধিগ্রহণ-উচ্ছেদ ঘিরে মামলাও নিশ্চয়ই কম হয়নি— পার্থ কিন্তু আদালতের নথি আদৌ ব্যবহার করেননি।
সিদ্ধান্ত বিপর্যয়ও ঘটেছে বেশ কিছু জায়গায়। লেখকের মতে বর্জ্য ও দুর্গন্ধ এড়াতে কারিগর সহ শিল্পগুলিকে সরিয়ে দেওয়া হয় শহরের প্রান্তিক অংশে (পৃ ১৭৮)। তা হলে কুমোরটুলি, ডোমপাড়া ইত্যাদি কী করে রয়ে গেল স্বস্থানে? শ্রেণীগত বিভাজন যে ভারতীয় নগরচরিত্রের পরিপন্থী, তা তো পার্থ নিজেই লিখেছেন (পৃ ১০৭)। অদ্যাবধি কলকাতায় বস্তিবিহীন ওয়ার্ড ক’টি? অবুঝ আমজনতাকে বোঝাতে না পেরে, ‘এলিট’-রাও নাকি গ্রহণ করেছিলেন নিয়ন্ত্রণের গা-জোয়ারি (প্রাককথন)। ‘এলিট’রা কি প্রতিবাদও করেননি? তা হলে দেবগণের মর্ত্যে আগমন-এ কেন লেখা হয়: ‘যাদের দেশ, যাদের মাটি, যাদের জল, তাদের জলে নামিয়া হস্তপদ ধৌত করিবারও অধিকার নাই!!’ রাজকোপের ভয়ে দুর্গাচরণ রায় পরের অনুচ্ছেদে ব্যাখ্যার প্রলেপ লাগালেও ঠোঁটকাটা হুতোম (লেখকের উল্লেখে ‘হুতুম’, পৃ ৩১১) কিন্তু লাটসাহেবকেও রেয়াত করেননি: ‘গবর্নরের গুয়ে দৃষ্টি সৃষ্টিছাড়া ব্যবহার।’ এলিটদের এই প্রতিবাদের ধারাবাহিকতা কি আঠাশজন কাউন্সিলরের পদত্যাগেও (১৮৯৯) প্রতিফলিত হয়নি?
এ বইয়ে বেভার্লি বা আগা কারবুলাই মুহাম্মদের বানান সর্বত্র বেঠিক, ‘রাইটার্স বিল্ডিংস’ সর্বত্র ‘বিল্ডিং’। কয়লাঘাটের নামান্তর ‘টাঁকশাল’ (পৃ ৪৯), গোলাম মহম্মদের মসজিদ ধর্মতলা ও এসপ্ল্যানেডের মোড়ে (পৃ ১৯৭), লালদিঘি ১৭৭০-এর দশকে খনিত (‘dug’, পৃ ২২), সার্কুলার ক্যানালে সেতু তৈরি হয় ব্যারাকপুরে-দমদমে, আদিগঙ্গায় সেতু ছিল নাকি ‘প্রাণনাথ’ ও গড়িয়াহাটে (পৃ ১৭১)— এ ধরনের ভুল এমন মূল্যবান গ্রন্থের মর্যাদাহানিকর।
ভুলভ্রান্তি পেরিয়ে কিন্তু এ বই নানা তথ্যে সমৃদ্ধ। পঞ্চম অধ্যায়ের শেষে যেমন উপস্থাপিত হয়েছে স্বপ্নের কলকাতা নির্মাণে সরকারি অসহায়তার কারণগুলি। এক দিকে পৌর রাজনীতিতে ভারতীয়দের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ ব্রিটিশ ধ্যানধারণার প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠেছিল, অন্য দিকে ভূমিব্যবহার নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন ব্যর্থ হওয়ায় বাড়ছিল বস্তির ব্যাপ্তি। ঘন ঘন ঘটছিল মহামারী, উনিশ-বিশ শতকের সন্ধিলগ্নে তাই মরিয়া সরকার দৃঢ় নীতি প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্ব পরিহার করেছিল। তবে এ গ্রন্থের শিরোরত্ন সিআইটি-র কর্মপন্থার পরিচয়দায়ী ষষ্ঠ অধ্যায়টি। সিসিল হেনরি বম্পাস, ম্যাডেন, শ্রসব্রি, ই পি রিচার্ডস বা প্যাট্রিক গেডেস-এর পরিবর্তনচিন্তার বিস্তারিত পরিচয় রয়েছে এখানে। সে কালেই রিচার্ডস যে পাতাল রেলের প্রস্তাব দেন, গেডেস যে পুরনো টাঁকশাল না ভেঙে স্থানীয় শিশুদের জন্য স্কুল বসাতে চেয়েছিলেন, তা ক’জন মনে রেখেছেন? পার্থ চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতিনিধি সিআইটি-র ক্ষমতার জোর, অন্তর্কলহে দীর্ণ বাঙালির সাময়িক প্রতিরোধ ও অবশেষে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার কাছে আত্মসমর্পণের ছবি। সাবেক কলকাতা বিভক্ত ছিল সাহেবি আর নেটিভ অংশে। সিআইটি-র দৌলতে যে জীর্ণ, বনেদি উত্তর ও ঝকঝকে নব্য দক্ষিণ কলকাতার মধ্যে নতুন এক ভেদরেখার জন্ম হয়, তা-ও কৃতিত্বের সঙ্গে দেখিয়ে দিয়েছেন লেখক।
নীলমণি মুখোপাধ্যায় কলকাতা বন্দরের ইতিহাস লিখেছিলেন, প্রজ্ঞানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় চিনিয়েছিলেন তার পশ্চাৎভূমি। সম্প্রতি প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে পোর্ট ট্রাস্ট-এর মহাফেজখানা। সিআইটি-র দস্তাবেজগুলির জন্যও অনুরূপ নথিঘর প্রয়োজন, আর তার নির্মাণের দায়িত্ব থাকা উচিত পার্থ দত্তর মতো নবীন গবেষকের কাঁধে। |
|
|
 |
|
|