কর্মীর অভাবে তালা বন্ধ লোক-সংস্কৃতির সংগ্রহশালা
ঙ্গলমহলে এসে বারে বারেই স্থানীয় পর্যটন প্রসারে নানা প্রকল্পের ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ খোদ মুখ্যমন্ত্রীরই দায়িত্বে থাকা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের ‘ঝাড়গ্রাম লোক সংস্কৃতি সংগ্রহশালা’টির বেহাল অবস্থা। কর্মীর অভাবে মাস চারেক ধরে সংগ্রহশালাটি তালাবন্ধ রয়েছে। পুরাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের দিক থেকে ঝাড়গ্রামের এই সংগ্রহশালাটির নিদর্শনগুলির গুরুত্ব অপরিসীম।
কিন্তু উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেক দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন নষ্ট হতে বসেছে।
সরকারি কাজের দিনে সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সংগ্রহশালাটি খোলা থাকার কথা। কিন্তু দু’টি কর্মী পদই (একজন করণিক ও একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী) শূন্য থাকায় সংগ্রহশালা খোলার মতোও লোক নেই এখন। দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, দু’বছর আগে সংগ্রহশালার করণিককের পদোন্নতি হওয়ায় ওই পদটি খালি হয়েছে। তারপর থেকে সংগ্রহশালাটির দেখভাল করতেন গ্রুপ-ডি কর্মী নিমাই টুডু। গত ৯ মে কর্মরত অবস্থায় নিমাইবাবুর মৃত্যু হয়। ওই দুই পদে নিয়োগ না হওয়ায় সংগ্রহশালা তাবন্ধ অবস্থাতেই পড়ে। ঝাড়গ্রাম মহকুমা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক কুশল চক্রবর্তীর অবশ্য দাবি, “দর্শকেরা আমার অফিসে এসে যোগাযোগ করলে সংগ্রহশালাটি ঘুরিয়ে দেখানো হয়। কর্মীর অভাবে সব সময় সংগ্রহশালাটি খোলা রাখা সম্ভব হচ্ছে না। শূন্য পদে কর্মী নিয়োগের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।”

ঝাড়গ্রামে তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের সংগ্রহশালা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
ঝাড়গ্রাম মহকুমার লোকশিল্প ও সংস্কৃতিকে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯৯৯ সালের জুনে মহকুমা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের অধীনে থাকা লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে ঝাড়গ্রামে একটি সরকারি সংগ্রহশালা গড়ে তোলা হয়। যার পোষাকি নাম‘ঝাড়গ্রাম লোক সংস্কৃতি সংগ্রহশালা’। এখানে ঝাড়গ্রাম মহকুমার আদিবাসী-মূলবাসী সম্প্রদায়ের শিল্প, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য-পরম্পরার লুপ্তপ্রায় বহু দুর্লভ নিদর্শন রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, চিল্কিগড় রাজবাড়ি থেকে সংগৃহীত চিল্কিগড় রাজ-ঘরানার প্রায় দু’শো বছরের পুরনো কাঠের মুখোশ ও বাদ্যযন্ত্র। কাঠের মুখোশগুলির বৈশিষ্ট্য হল, এক একটি আস্ত কাঠকে খোদাই করে ‘দশভূজা’, ‘অষ্টভূজা’, ‘গণেশ’, ‘কার্তিক’, ‘হরগৌরী’ ও ‘যম’ ইত্যাদি দেবদেবীর ‘পরভা’ তৈরি করা হয়েছে। ‘পরভা’ বলতে বোঝায় কাঠের তৈরি দেবদেবীর অবয়বের উর্ধ্বাঙ্গ। চিল্কিগড় রাজাদের উদ্যোগে এক সময় স্থানীয় ঘরানার ছৌ নৃত্য পরিবেশিত হতো। ছৌ নাচের সময় ‘পরভা’গুলিকে মাঠের একপাশে রেখে বন্দনা করা হতো। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে অধূনা ঝাড়খণ্ডের ধলভূমগঢ়ে সেখানকার রাজবাড়ি থেকে বৈবাহিক সূত্রে ‘পরভা’গুলি পেয়েছিল চিল্কিগড় রাজ পরিবার। এ ছাড়াও চিল্কিগড় রাজবাড়ির নিজস্ব ছৌয়ের কিছু মুখোশ আছে সংগ্রহশালায়। চিল্কিগড় রাজবাড়ি থেকে প্রাপ্ত তিনটি ধমসা ও একটি জয়ঢাকও রয়েছে সংগ্রহশালায়। সংগ্রহশালাটিতে সুবর্ণরৈখিক এলাকার বেশ কিছু নিদর্শনও রয়েছে। অষ্টাদশ শতকে নয়াগ্রাম এলাকাটি ওড়িশার অন্তর্গত ছিল। ওই সময় ময়ূরভঞ্জের রাজানুগ্রহে রণকৌশলের চর্চা হত। বর্গি-হামলা ঠেকানোর জন্য স্থানীয় রাজা-জমিদারদের সৈন্যেরা হামেশাই যুদ্ধে লিপ্ত হতেন। সেই সময়ের নয়াগ্রামে যুদ্ধে ব্যবহৃত তলোয়ার, গুপ্তছোরা ও কুড়ি কিলোগ্রাম ওজনের মস্ত একটি রামদা’র মতো নানা অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে সংগ্রাহশালায়। রয়েছে নয়াগ্রামের ব্যদ্যযন্ত্র, হস্ত ও কুটিরশিল্পের বেশ কিছু নিদর্শন। মহকুমার বিভিন্ন এলাকার শিল্পী ও গবেষকেরা তাঁদের সৃষ্টি-সম্ভার ও সংগ্রহে থাকা অমূল্য জিনিসপত্র গুলি সংগ্রহশালায় দান করেছেন । অন্যান্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে আদিবাসী নৃত্যসজ্জার উপকরণ, শিকারের অস্ত্র, বেলপাহাড়ির ঢাঙিকুসুম গ্রামের পাথরের বাসন, মুনিয়াদা গ্রামের অধূনালুপ্ত পুতুল নাচের কাঠের পুতুল, ঘোড়ার পুতুল, লাঠি খেলার পুতুল, গণেশ পুতুল, বায়েন পুতুল, ছোরা খেলার পুতুল, রণপা, ঢেঁকি, মাছ ধরার বাহারি ফাঁদ, প্রাচীন কালের নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী, শীতলামঙ্গলের পট, বেলপাহাড়ির লালজল গুহায় পাওয়া নব্যপ্রস্তর যুগের আদিম মানবের কুঠার, মৃগজাতীয় প্রাণীর শিংয়ের জীবাশ্ম। লোকসংস্কৃতি বিষয়ক একটি গ্রন্থাগারও আছে।
ঝাড়গ্রামের বিশিষ্ট লোকশিল্প ও সংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “উপযুক্ত প্রচার ও প্রসারের অভাবে সরকারি সংগ্রহশালাটি প্রায় দেড় দশক ধরে কার্যত উপেক্ষিত থেকে গিয়েছে। সংগ্রহশালাটিকে বাতানুকুল করা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞ কর্মী নিয়োগ করাও দরকার। কিন্তু, কিছুই করা হয়নি। লোক সংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতির প্রাচীন অমূল্য নিদর্শনগুলি নষ্ট হতে বসেছে।” রাজ্য লোক সংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্রের সচিব মতিলাল কিস্কু বলেন, “সংগ্রহশালাটির সম্প্রসারণের জন্য ও কর্মী নিয়োগের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ করা হবে।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.