নদীর বাঁধ উপচে জলমগ্ন নতুন এলাকা
চার দিনের টানা বৃষ্টির পর বৃহস্পতিবার রোদের দেখা মিলেছিল। নতুন করে বৃষ্টি না হওয়ায় দুই মেদিনীপুরের কিছু জায়গায় পরিস্থিতির উন্নতি হল। তবে কোথাও বাঁধ ভেঙে, উপচে পড়ে আবার কোথাও ব্যারাজের ছাড়া জলে নতুন করে জলমগ্ন হল পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া, ময়না, পাঁশকুড়া, রামনগর-সহ পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুর।
আশঙ্কা সত্যি করে, ব্যারাজের ছাড়া জলে কংসাবতী নদী তীরবর্তী পূর্ব মেদিনীপুরের ময়না ও পাঁশকুড়া এলাকায় জলমগ্ন হল বেশ কিছু গ্রাম। শুক্রবার দুপুরে পাঁশকুড়ার গোবিন্দনগর গ্রামে জলে ডুবে মৃত্যু হল দেড় বছরের শিশুকন্যা সাবিয়া খাতুনের। সন্ধ্যায় পাঁশকুড়া পুরসভার ১৪ নং ওয়ার্ডের গড় পুরুষোত্তমপুরে কংসাবতী নদীর প্রায় কুড়ি ফুট বাঁধ ভেঙে হু হু করে জল ঢুকতে শুরু করে পুরসভা এলাকায়। এ দিনও কংসাবতী নদীর জল বিপদসীমার উপর দিয়ে বয়েছে। কংসাবতীর জল ঢুকে গোবিন্দনগর গ্রামের প্রায় ২০০টি বাড়ি জলমগ্ন হয়েছে। কংসাবতীর সঙ্গে যুক্ত পাঁশকুড়ার ক্ষীরাই-বাক্সী নদীর রাধাবন এলাকায় ভাঙা নদীবাঁধ দিয়ে জল ঢুকে হাউর এলাকার ১৫টি গ্রাম জলমগ্ন হয়েছে। এ দিন কংসাবতী নদীর বাঁধ উপচে ময়নার বেশ কিছু এলাকায় নতুন করে জল ঢোকে। ময়নার চণ্ডীয়া নদীর জলও বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। গত রবিবার থেকে বুধবার পর্যন্ত প্রবল বৃষ্টি ও কংসাবতী, সুবর্ণরেখা ব্যারাজ থেকে জল ছাড়ার ফলে পরিস্থিতি সঙ্কটজনক হয়। বৃহস্পতিবার কংসাবতী ও চণ্ডীয়া নদীর জলস্তর চরম বিপদসীমা অতিক্রম করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পাঁশকুড়ার হাউর ও চৈতন্যপুর এলাকার ৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ত্রাণ শিবির খোলে প্রশাসন। রাতে নদীর জলস্তর বৃদ্ধি পেয়ে চরম বিপদসীমা অতিক্রম করে। স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য হরিশচন্দ্র প্রামাণিক জানান, এলাকার প্রায় ১০ হাজার মানুষ জলবন্দি হয়ে পড়েছেন। শুক্রবার দুপুরে পাঁশকুড়ার কংসাবতী তীরবর্তী গোবিন্দনগর গ্রামে জলবন্দী হয়ে থাকা শেখ সইফুল ইসলামের বাড়ির উঠোন থেকে জলে পড়ে গিয়ে দেড় বছরের শিশুকন্যা সাবিয়া খাতুনের মৃত্যু হয়। ওই গ্রামের প্রায় ২০০টি বাড়ি জলমগ্ন হয়ে রয়েছে। পাঁশকুড়ার জদড়া ও রায়বাঁধ এলাকায় কংসাবতীর বাঁধে ফাটল দেখা দেওয়ায় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়।

ডুবেছে রাস্তা। অগত্যা এ ভাবেই যাতায়াত। ঘাটাল শহরে তোলা ছবি।—নিজস্ব চিত্র।
ঘাটাল মহকুমার প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ এলাকা জলমগ্ন রয়েছে। কংসাবতী জলাধার থেকে জল ছাড়ায় দিন দিন ঘাটাল মহকুমায় পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। শুক্রবারের ওই জলাধার থেকে ৪০ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। কংসাবতী নদীর জল চরম বিপদ সীমা অতিক্রান্ত করে নদী বাঁধের এক মিটার কোথাও দেড় মিটার নিচে দিয়ে বইছে। একই অবস্থা শীলাবতী, পলাশপাই, কাঁসাই, ঝুমি নদীরও। সেচ দফতরের অধীনে থাকা বেশির ভাগ বাঁধ এবং জমিদারি বাঁধগুলির অবস্থা খুবই খারাপ। যে কোনও মুহুর্তে ওই বাঁধগুলি ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা করছে মহকুমা প্রশাসন। বিশেষ করে দাসপুরের কংসাবতী নদীর বাঁধ। শুক্রবার দাসপুরের একাধিক এলাকায় স্থানীয় বিডিও, মহকুমার একাধিক কর্তাদের সঙ্গে সেচ দফতর ও জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলার লোকজন বালির বস্তা নিয়ে নদীবাঁধ উঁচু করার চেষ্টা করেন। তবে তাতেও বিপদ কাটবে না বলেই আশঙ্কা প্রশাসন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের। ঘাটালের মহকুমাশাসক অংশুমান অধিকারী বলেন, “এখন নদী বাঁধ নিয়েই আমরা চিন্তিত। মেরামতির চেষ্টা করছি। রাতেও নজরদারি চালানো হচ্ছে।” সেচ দফতরের মহকুমা আধিকারিক নমিত সরকার জানান, আপাতত বালির বস্তা দিয়ে যতটা সম্ভব বাঁধ উঁচু করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
শুক্রবারও ঘাটাল মহকুমায় নতুন করে সত্তরটি গ্রাম জলমগ্ন হয়েছে। দাসপুর ১ ও ২ ব্লকেই বেশি। দাসপুর ২ ব্লকে পলাশপাই পঞ্চায়েতে কাঁসাই নদীর বাঁধে জল উঠে যাওয়ায় ওই এলাকা থেকে প্রায় দুশো মানুষকে সরিয়ে চারটি ত্রাণ শিবিরে রাখা হয়েছে। স্থানীয় বিডিও অরূপ মণ্ডল জানিয়েছেন, ওই পঞ্চায়েতের পলাশপাই প্রাথমিক স্কুল, পঞ্চায়েত অফিস, স্থানীয় এক সেচ দফতরের বাংলো এবং আজুড়িয়া স্কুলে ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে। এ দিকে ঘাটাল ব্লকের দশটি পঞ্চায়েতের প্রায় দুশো গ্রাম, চন্দ্রকোনা ১ ব্লকের তিনটি পঞ্চায়েতের একাধিক গ্রাম এবং দাসপুর ১ ব্লকের ৬টি পঞ্চায়েতের প্রায় দেড়শো গ্রাম জলমগ্ন হয়েছে। বিশেষ করে নন্দনপুর ২, নাড়াজোল, রাজনগর, সরবেড়িয়া ১ ও ২ পঞ্চায়েতের অধিকাংশ এলাকার বিপর্যস্ত অবস্থা। গত বছরে নাড়াজোল অঞ্চলে মেটাশোর ও রাইকুণ্ডু গ্রামের কংসাবতী নদীর জমিদারি বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। এ বারেও একই অবস্থা। পানীয় জলেরও আকাল দেখা দিয়েছে। পর্যাপ্ত নৌকাও নেই বলে গ্রামবাসীদের অভিযোগ। বিপর্যস্ত হয়েছে চাষাবাদ, যোগাযোগ ব্যবস্থাও।
সুবর্ণরেখা নদী উপচে রামনগর ১ ব্লকের বাধিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের পাঁচটি গ্রাম জলমগ্ন হয়েছে। রামনগর ১ ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক তমোজিৎ চক্রবর্তী জানান, ডিভিসি চাণ্ডিল ব্যারাজ থেকে প্রায় ৬ লক্ষ কিউসেক জল ছাড়ায় সুবণর্র্রেখার জলস্ফীতি হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে সুবর্ণরেখার জলে বাধিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের কাণ্ডগ্রাম, কচুয়া, বারবটিয়া, উত্তর বাধিয়া ও বাখরপুর প্লাবিত হয়েছে। ইতিমধ্যেই প্রায় পাঁচ ফুট উচ্চতায় জল দাঁড়িয়েছে। ডিভিসি যদি আরও জল ছাড়ে তা হলে আরও প্রায় সাত থেকে আট হাজার মানুষ বিপন্ন হয়ে পড়বেন। এলাকায় তিনটি ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে। তা ছাড়া বাধিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে একটি একটি অস্থায়ী কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাতে আচমকা কেশপুরের এনায়েতপুরের গোবিন্দপুরে বাঁধ ভাঙে। সব মিলিয়ে ১৪টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বহু গবাদি পশু, আসবাব জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছে। নদীর পাশে বাড়ি গুনধর বাস্কের। তাঁর কথায়, “হঠাৎই দেখি, বাঁধ ভেঙে নদীর জল গ্রামে ঢুকতে শুরু করেছে। পরে প্রতিবেশীদের মতো হাঁটুজল ঠেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি।” প্রায় একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হন গুরাই মুর্মু, জ্যোতিরাম টুডু। এক যুবকের কথায়, “রাতের বেলায় জল বেড়ে বাঁধ ভাঙলে যে কী হত, ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠছি।” জেলাশাসকের নির্দেশে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে কেশপুরে যান মহকুমাশাসক (সদর) অমিতাভ দত্ত। গোবিন্দপুর, মহেশপুর, বাগরুই এবং ঢোবাগেড়্যা এই ৪টি এলাকা ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাকুড়িয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন। স্থানীয় রাধাগোবিন্দ সেবাশ্রমে জল ঢুকে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এসেছেন স্থানীয় যুবকেরাও। চকমনসুরের একটি ক্লাবের সদস্যরা যেমন খিচুড়ি রান্না করে দুর্গতদের মধ্যে বিলি করেন। জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, গোবিন্দপুরের বাঁধ ভেঙে সবমিলিয়ে ৫৫ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ৯৯টি বাড়ি সম্পূর্ণ এবং ২১২টি বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কেশপুরে ৬২৫টি ত্রিপল, চিঁড়ে, গুড় ও ১০ হাজার পানীয় জলের পাউচ পাঠানো হয়েছে। নতুন করে ভারী বৃষ্টি না হওয়ায় সবং, ডেবরা, কেশিয়াড়ির পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। জেলার অন্যত্র পরিস্থিতির উন্নতি হতেও বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে কেশপুরের বেশ কিছু এলাকা। ঘর ছেড়ে বহু মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন অন্যত্র। খোলা হয়েছে ত্রাণ শিবির। কংসাবতী নদীর জল ডেবরা, কেশপুরের কাছে বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। নতুন করে বৃষ্টি না হলে এবং ব্যারাজ থেকে জল ছাড়া না হলে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলেই মনে করছে জেলা প্রশাসন। জেলাশাসক গুলাম আলি আনসারির বক্তব্য, “জল নামতে শুরু করেছে। তবে, পরিস্থিতির উপর নজর রাখা হয়েছে।”

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.