হাঁড়ির খবর
ঝাল ফ্রেজি থেকে প্যানথেরাস
নৈনিতাল-আলমোড়ার পথের পাহাড়ি ধাবায় ঢুকে এমন অভিজ্ঞতা অনেকেরই হয়েছে। মেনুতে বিশিষ্ট উপস্থিতি, মুর্গ কালি মির্চ। কলকাতার ট্যুরিস্টের তা দেখে মনে পড়তেই পারে, আরে, ক’দিন আগেই কেজো কনফারেন্সে পাঁচতারার ব্যাঙ্কোয়েটেও তো এটাই বুফেয় ছিল। স্বাদটা অবিকল না-ও মিলতে পারে। তবু পাঁচতারার মরিচগন্ধী থকথকে সাদা গ্রেভির চিকেনের প্রেরণা উত্তরাঞ্চলের এই ধাবার খানা।
ব্রিটেনের শিল্পাঞ্চলের বিখ্যাত মাছভাজা (ফিশ অ্যান্ড চিপস) থেকে শুরু করে ব্যাঙ্ককের রাস্তার রাইস বল স্যালাড বা চিকেন সাতে অবধি একই ধাঁচে কলকাতার অভিজাত রেস্তোরাঁর হেঁসেলে জন্ম নিচ্ছে। তা হলে, কলকাতার কেবিন-রেস্তোরাঁর মুখরোচক ভাজাভুজিই বা কী দোষ করল? ঝটিকা সফরে কলকাতায় এসে যাঁরা পাঁচতারা হোটেলের নিশ্চরিত্র ভোজ্য কোনওমতে নাকেমুখে গুঁজে ফিরে যেতে বাধ্য হন, তাঁদের কথা ভেবে ইদানিং এগিয়ে আসছে কয়েকটি স্ট্যান্ডঅ্যালোন রেস্তোরাঁ। এই তালিকায় নবতম সংযোজন নিউটাউনের অ্যাক্সিস মলের ছ’তলায় ক্যালকাটা রেট্রো।
শুধু কেবিন-রেস্তোরাঁ নয়, পার্ক স্ট্রিটের রকমারি ক্লাসিক সৃষ্টি কিংবা ময়রার ভেনঘরের উৎকর্ষ মিলিয়েই কলকাতার মহিমা। কালে-কালে যা মিলেজুলে প্রায় পাহাড়-প্রমাণ ক্যালকাটা কুইজিনের চেহারা নিয়েছে। এই নাগরিক বাঙালিয়ানাকে তুলে ধরতে একদা এগিয়ে এসেছিল ওহ্ ক্যালকাটা রেস্তোরাঁ। ক্যালকাটা রেট্রো সেই ঘরানারই পথিক।
ওহ্ ক্যালকাটা-র মেনুতে গোড়ার দিকে প্যানথেরাস বা কবিরাজি কাটলেটের দেখা মিলত। যে কোনও কারণেই হোক, এখন তা রোজকার মেনুতে নেই। ক্যালকাটা রেট্রোয় গিয়ে অ-নেক দিন বাদে সেই প্যানথেরাসের দেখা মিলল। অনেকটা মাংসের পুর-ভরা প্যানকেক বা পাটিসাপ্টাগোছের বস্তু। ওপরটা কড়া ভাজা। একটা সময় ছিল, যখন শ্যামবাজারের গেরস্ত বাঙালিপাড়া থেকে বহুভাষী পার্কসার্কাস-বেনিয়াপুকুর-নিউমাকের্ট এলাকায় সন্ধের মেজাজটা প্যানথেরাসের গন্ধই বেঁধে দিত। বর্মামুলুক-ঘেষা চট্টগ্রাম থেকে শ্যামবাজারে হাজির মগ সূপকারদের হাতের প্যানথেরাস না কি মুসলিম মহল্লার কারিগরদের হাতের প্যানথেরাস কে যে সেরা তা-ও নিশ্চিত বলা যায় না। এখন রমজানের মাসটা বাদ দিলে সেই প্যানথেরাস প্রায় অদৃশ্য। শ্যামবাজারে চৌধুরী লেনের প্যানথেরাসের কৌলীন্যও পড়ে গিয়েছে বহু দিন। নামমাত্র দামে মান বজায় রাখা কী করেই বা সম্ভব! তবু কলকাতার বহুভাষী বিচিত্র সংস্কৃতির ধারক হিসেবে প্যানথেরাসের সমমর্যাদার কোনও খাবার খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। ক্যালকাটা রেট্রো সবার আগে এই মাটন প্যানথেরাসের সৌজন্যেই কলকাতা-প্রেমিকের মন ভরিয়ে দেয়।
সেকেলে কেবিনের ফাউল কাটলেট এবং মোক্যাম্বোর ফিশ ডায়ানার আদলে চিংড়ির পুর-ঠাসা ভেটকি ফিলেও তাদের আর একটি সিগনেচার। এখন অতীত স্কাইরুমের চিকেন টেট্রাজিনি-প্রন ককটেল বা পিটারক্যাটের মাটন স্ট্রগানফেরও ক্যালকাটা রেট্রোয় নয়া অবতার। ধ্রুপদী কন্টিনেন্টাল পদের সঙ্গে সমকালের মোচড়ে তারা কখনও হাজির করছে টমেটো কেচাপ-কাসুন্দির ককটেল টম-কাসুন্দি, কখনও বা মেক্সিকান সালসার সঙ্গে অলিভ অয়েলে নাড়া-চাড়া করা সেদ্ধ সব্জি। এ সব উৎকর্ষ সাধনার সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলছে ঘরোয়া আমকাসুন্দিযোগে কাঁকড়ার ঝাল সৃষ্টি, মুচমুচে নারকেল-পোস্তর বড়া কিংবা রাবড়ি-চমচমের নির্মাণ। ক্যামেলিয়া গ্রুপের রেস্তোরাঁ ক্যালকাটা রেট্রো-র শেফ অনিন্দ্য দাশগুপ্ত বলছিলেন, “ঝকঝকে রেস্তোরাঁয় খেতে এসে অনেকেই এই চেনা স্বাদগুলো মিস করেন। এটা মাথায় রেখেই এখানে এক ছাদের নীচে গোটা কলকাতাকে হাজির করার চেষ্টা করছি।”
সার্কাস অ্যাভিনিউয়ে শহরের একটি পুরনো বনেদি বাড়িকে ঢেলে সেজে গড়ে ওঠা রেস্তোরাঁর থিমেও চিরকালীন কলকাতা। অম্বুজা- গোষ্ঠীর রেস্তোরাঁটির নাম ঝাল ফ্রেজি। সেখানেও শেফরা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বাড়ি-বাড়ি ঘুরে বা সাবেক ক্লাবগুলোয় হানা নিয়ে মেনু নিয়ে জব্বর রিসার্চ করেছেন। রেস্তোরাঁয় একটি কাফে থাকলেও লাঞ্চ-ডিনারের মূল রেস্তোরাঁটিতে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ঘরের সুখাদ্যের ছড়াছড়ি। কর্পোরেট শেফ সুমন্ত চক্রবর্তী বলছিলেন, “খানার ব্যবস্থা সর্বজনীন করার জন্য মেনু থেকে বিফ-পর্ক বাদ দেওয়া হয়েছে।” ঝাল ফ্রেজি-র দায়িত্বে শেফ স্বরূপ চট্টোপাধ্যায়। ঝাল ফ্রেজিও প্যানথেরাসকে ধরে রেখেছে। থাকছে অ্যাংলো ঘরের রোববারের লাঞ্চ স্পেশাল ইয়েলো রাইসযোগে মাটন কোফতার বল কারি, পেঁয়াজ-শুকনো লঙ্কায় সুখা-সুখা মাংস বা সব্জির ঝাল ফ্রেজি। দক্ষিণী রান্না মাছের মইলুরও এ তল্লাটে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ও কসমোপলিটানমনস্ক বাঙালিঘরে ব্যাপক কদর। তেঁতুলের রসের ঝটকায় সেই মইলু ঝাল ফ্রেজিতে বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে। উত্তর কলকাতায় অ্যালেন্স কিচেনের ঘি-সুরভিত হাল্কা মিষ্টি চিকেন বা মাটন স্টেক যাঁদের এখনও খাওয়া হয়নি তাঁরাও ঝাল ফ্রেজি-তে ঢুকতে পারেন। শাকাহারীদের কথা ভেবে পোট্যাটো ঘি রোস্টও পেশ করা হচ্ছে।
পুরনোকে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি নতুন ও পুরনোকে মেলানোও ক্যালকাটা কুইজিনের ধর্ম। ওহ্ ক্যালকাটার পরে বালিগঞ্জের বোহেমিয়ান রেস্তোরাঁয় শেফ জয়মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায় এই কাজটা দীর্ঘদিন করে আসছেন। কন্টিনেন্টাল ডেভিল্ড ক্র্যাবের আদলে কাঁকড়ামাংসে অনায়াসে কলমিশাক ভরে দিচ্ছেন শেফ জয়। ক্যালকাটা রেট্রোয় ঢাকাই ফিশ টিক্কাতেও এই সৃজনশীলতার ছোঁয়াচ। মেছো কাবাবে বাঙাল স্টাইলে কাঁচা তেলের ছোঁয়া আলাদা মাত্রা জুড়েছে। এ সব স্বাদ-গন্ধেই রসিকের জিভে বার বার জন্ম নিচ্ছে আমাদের কলকাতা।

ছবি: শুভেন্দু চাকী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.