কলের গান
হৃদয়খানা ঘুরে মরে...
সিডি বিক্রি কমে যাওয়ায় সম্প্রতি বন্ধ হয়েছে পার্ক স্ট্রিটের মিউজিক ওয়ার্ল্ড। ঠিক সেই সময়ে বাজারে বিক্রি হচ্ছে নতুন তৈরি কলের গান। বাজারে চাহিদা থাকায় নতুন করে তৈরি হচ্ছে গ্রামোফোন। শুধু গান শোনার যন্ত্র হিসেবে নয়, ঘর সাজানোর উপকরণ হিসেবেও রয়েছে এর চাহিদা।
ওয়েলিংটন, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, শিয়ালদহের চোরাবাজার, কিংবা লালবাজারের পুরনো রেকর্ডের দোকানে দেখা যায় এই নতুন গ্রামোফোন। কলকাতার পাশাপাশি দিল্লি, পটনা, মুম্বই বা চেন্নাইতেও মেলে এই নতুন গ্রামোফোন। অনেকে একে বলেন ‘নকল গ্রামোফোন’। কারণ এগুলিতে রেকর্ড বাজানো গেলেও এগুলি কোনও নামী কোম্পানির ব্র্যান্ড নয়।
কোথায় তৈরি হয় গ্রামোফোন? লালবাজারের গ্রামোফোন ব্যবসায়ী ও মিস্ত্রি মহম্মদ দিলজান (বাবুয়া) বললেন, “মূলত উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হয় নকল গ্রামোফোনের বিভিন্ন অংশ। যেমন কাঠের বাক্স ও সাউন্ডবক্স তৈরি হয় দিল্লিতে, দম দেওয়া মেশিনটি তৈরি হয় মুরাদাবাদে, চোঙা তৈরি হয় মুরাদনগরে। তারপর এই সব যন্ত্রাংশ জুড়ে তৈরি হয় নকল গ্রামোফোন। এ বার এগুলি পাঠানো হয় বিভিন্ন শহরে। তবে উত্তরপ্রদেশ ছাড়াও মুম্বইতেও তৈরি হয় নকল গ্রামোফোন।”
তবে এ শহরে কেমন চাহিদা এই নকল গ্রামোফোনের? মহম্মদ দিলজান আরও জানালেন মাসে কম করে ২০টির মতো গ্রামোফোন বিক্রি হয়। এ ছাড়াও আসল গ্রামোফোনেরও চাহিদা আছে। অন্য দিকে ওয়েলিংটনের রেকর্ড ও গ্রামোফোন ব্যবসায়ী মহম্মদ ইলিয়াস বললেন, “নতুন তৈরি চোঙাওয়ালা গ্রামোফোনের দাম কম। তাই অনেকেই কিনে বাড়িতে সাজিয়ে রাখেন, গানও শোনেন। তবে আসল গ্রামোফোনের স্প্রিং অনেক মজবুত হত, আওয়াজও ভাল। বেশির ভাগ পুরনো গ্রামোফোন দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, কেননা সেখানে চড়া দামে এগুলি বিক্রি হয়।”
তবে শিয়ালদহ চোরাবাজারের রেকর্ড ব্যবসায়ী সুখেন্দু সরকার ও শুভেন্দু সরকার জানালেন কলকাতার পাশাপাশি মফস্সলেও এমনকী ভিন্ন জেলাতেও এর চাহিদা আছে। নতুন গ্রামোফোনে পুরনো মডেলের স্প্রিং, সাউন্ডবক্স, ব্র্যাকেট ইত্যাদি লাগিয়ে নিয়ে সাউন্ড রিপ্রোডাকশন সেই আসল মেশিনের মতই হয়। তাতে দাম একটু বেশি পড়ে।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত এই কলের গানই ছিল রেকর্ড শোনার প্রধান উপকরণ। তবে একদম গোড়ার দিকে ছিল এডিসনের ফোনোগ্রাফ আর সিলিন্ডার রেকর্ড। এক সময় তা হারিয়ে যায়। তবে দীর্ঘদিন বাজারে টিকেছিল গালার ডিস্ক রেকর্ড। সময়ের সঙ্গে বদলাতে থাকে রেকর্ড বাজানোর উপকরণ। পরবর্তী কালে বাজারে আসে ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড প্লেয়ার। ফলে বাতিল হয়ে যায় গ্রামোফোন। আর পরবর্তী কালে তাই হয়ে ওঠে কালেক্টর্স আইটেম।
গ্রামোফোন হত হরেক রকম, যেমন চোঙাওয়ালা, পোর্টেবল বক্স গ্রামোফোন, কেবিনেট মেশিন কিংবা গ্র্যান্ড কনসার্ট গ্রামোফোন। এগুলি তৈরি করত ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’, ‘মেগাফোন’, ‘সেনোলা’ ইত্যাদি কোম্পানি। এখন একটা আসল গ্রামোফোনের দাম পড়তে পারে কম করে সাত হাজার টাকা থেকে পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে সেটা নির্ভর করে কোন মডেল তার উপর।
ওয়েলিংটনে গ্রামোফোন কিনতে এসে দরদামে ব্যস্ত গড়িয়াহাটের সুবীর রায় বললেন, “এ পথে বাড়ি ফেরার সময় রোজই দেখতাম চোঙাওয়ালা গ্রামোফোন। ইচ্ছে ছিল একটা কেনার। পুরনো না পেলেও নতুন তৈরি একটা গ্রামোফোন পেয়ে গেলাম সঙ্গে কিছু রেকর্ডও।”
তবে কী বলছেন রেকর্ড ও গ্রামোফোন সংগ্রাহকরা? সুশান্তকুমার চট্টোপাধ্যায় বললেন “নকল গ্রামোফোনের গুণগতমান হয়তো ভাল নয়। তবু গ্রামোফোন তৈরি হচ্ছে বলেই অনেকে তা কিনছেন, আর পরিচিত হচ্ছেন অতীতের যন্ত্রটির সঙ্গে।”
কলের গান প্রসঙ্গে প্রবীণ সঙ্গীতশিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় বললেন, “গ্রামোফোনে দম দিয়ে, সাউন্ড বক্সে নতুন পিন ভরে একটা রেকর্ড চাপিয়ে গান শোনার সেই অদ্ভুত অনুভূতি আজও স্মৃতিমেদুর করে তোলে। সে যুগে কলকাতার চাইতে গ্রাম বাংলায় বেশি প্রচলন ছিল চোঙাওয়ালা গ্রামোফোনে গান শোনার। তবে ছবিটা আজ বদলেছে। ড্রয়িংরুমে গ্রামোফোন সাজিয়ে রাখাটা একটা ফ্যাশন হয়ে উঠেছে। তবু কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ আছেন যাঁরা আজও কলের গানে গান শোনেন। তবে চাহিদা থাকায় গ্রামোফোন নতুন করে তৈরি হচ্ছে এটা ভালই।”
আজ মাউসের এক ক্লিকেই পছন্দের গান শোনা যায়। তবু বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে যায়নি স্মৃতিবিলাসের গ্রামোফোন। হয়তো গানপাগল বাঙালির হৃদয়খানা আজও ঘুরে মরে গ্রামোফোনের ডিস্কে।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.