পরিত্যক্ত কারখানায় গণধর্ষিতা চিত্রসাংবাদিক
ট মাস আগে দিল্লিতে নির্ভয়ার গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিল মুম্বই। আজ আবার গর্জে উঠতে হল, নিজের ঘরের মেয়ের জন্য।
ভারতের চারটি মেট্রো শহরের মধ্যে মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য মুম্বইয়েরই সুনাম ছিল সবচেয়ে বেশি। দেশের বাণিজ্য রাজধানী বলতে বোঝাত এমন একটা শহর, যে কখনও ঘুমোয় না। যেখানে দিনে-রাতে মেয়েরা পুরুষদের সঙ্গে সমান তালে রাস্তায় বেরোন। যে শহর একাধিক জঙ্গি নাশকতা সামলে ঘুরে দাঁড়ায়।
বৃহস্পতিবার, ২২ অগস্টের রাত মুম্বইয়ের এই চেনা চেহারাটা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিল। সাম্প্রতিক কালে যে ভাবে ধর্ষণের একাধিক ঘটনায় দিল্লি, কলকাতা খবরের শিরোনাম হয়েছে, সেই তালিকায় নাম উঠে গেল মুম্বইয়েরও। বৃহস্পতিবার সন্ধে নামার আগেই পারেল এলাকার একটি কারখানা চত্বরে ছবি তুলতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার হলেন ২৩ বছর বয়সী এক চিত্রসাংবাদিক। দিল্লির ঘটনাকে মনে করিয়ে দিয়ে এখানেও মেয়েটির সঙ্গী-সহকর্মী পুরুষটিকে বেধড়ক মারধর করা হল। তাঁকে বেল্ট দিয়ে বেঁধে রেখে মেয়েটিকে টেনে নিয়ে গেল পাঁচ জনে। দিল্লির নির্ভয়ার মতোই এখানেও তরুণীর বয়ানের ভিত্তিতেই পুলিশ ঝটিতি এঁকে ফেলল অভিযুক্তদের স্কেচ। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ধরাও পড়ল এক জন। মুম্বই পুলিশের দাবি, বাকি চার জনকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই তারা ধরা পড়বে।
আরও একটা আশার কথা, নির্যাতিতা এবং তাঁর সহকর্মী দু’জনেরই শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে।
অভিযুক্তদের এই স্কেচ প্রকাশ করেছে পুলিশ। ধরা পড়েছে এক জন। ছবি: পি টি আই।
কিন্তু শুক্রবার দিনভর মুম্বই-সহ গোটা দেশকে একটাই প্রশ্ন তাড়া করে বেড়াল, মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা যাবে কী ভাবে। দিল্লিতে নির্ভয়ার ঘটনার পরে কঠোরতর ধর্ষণ-বিরোধী আইনের দাবি উঠেছিল। নতুন আইন তৈরি হয়েছে। তবু ধর্ষণের ঘটনা আটকানো যায়নি। বিক্ষোভে-প্রতিবাদে-ধর্নায়-সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন জনে জনে সেলিব্রিটি থেকে শুরু করে আমজনতা, রাজনৈতিক নেতা থেকে সংবাদমাধ্যমের কর্মী সকলেরই প্রশ্ন, এ বার তবে কী? ফেটে বেরিয়েছে রাগ আর হতাশা। সমাজের সব স্তরের মানুষই একটা দাবি জানাচ্ছেন, শুধু আইন করাই যথেষ্ট নয়। দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশাসন আর বিচারবিভাগের মন্থরতা কাটাতে হবে। মহারাষ্ট্র সরকার ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে বিচার হবে। সরকার মেয়েটির জন্য উজ্জ্বল নিকমের মতো নামজাদা আইনজীবীকে দাঁড় করাতেও রাজি আছে। নির্যাতিতার চিকিৎসার সমস্ত খরচও সরকার বহন করবে। বৃহস্পতিবার রাতে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর আর পাটিল এবং শুক্রবার রাতে মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চহ্বাণ সস্ত্রীক যশলোক হাসপাতালে গিয়ে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করে আসেন। পাটিল বলেন, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা চার্জশিট ফাইল করব। আমি কথা দিচ্ছি বিচার এতটাই কঠিন হবে, ভবিষ্যতে কেউ এমন করার সাহস পাবে না।”
এমনিতে আজ সারাদিন অবশ্য বিজেপি রাজ্যে এবং সংসদে রাজ্য সরকারের ‘অপদার্থতা’র বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়েছে। আর আর পাটিলের ইস্তফা দাবি করেছে। শিবসেনা তার নিজস্ব স্লোগান ব্যবহার করে অভিযোগ করেছে, মুম্বইয়ে বহিরাগতদের সংখ্যা বাড়ার ফলেই অপরাধ বাড়ছে। এ দিন রাজ্যসভায় মুম্বই গণধর্ষণের প্রসঙ্গটি প্রথম তোলেন বিজেপির স্মৃতি ইরানি। তার পরেই সভায় হট্টগোল শুরু হয়ে যায়।
এই পরিত্যক্ত কারখানা চত্বরেই তরুণী চিত্রসাংবাদিককে গণধর্ষণ করা হয়। ছবি: এ এফ পি।
সাংসদরা একযোগে অভিযোগ করতে থাকেন, মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টি কোনও ভাবেই নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। মুম্বইয়ের ঘটনাটি শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে আটকে না থেকে দেশ জুড়ে একের পর এক ধর্ষণ এবং সার্বিক ভাবে মেয়েদের প্রতি নির্যাতনের বিষয়টির সঙ্গে জুড়ে যায়। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কপিল সিব্বল বলেন, “মেয়েরা এবং শিশুরা সুরক্ষা পাবে না, এটা কোনও মতেই মানা যায় না। তাদের প্রতি আক্রমণ হলে তার জন্য কঠোরতম ব্যবস্থা নিতে হবে।” কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে বলেন, মুম্বই পুলিশের কাছ থেকে বিশদ রিপোর্ট চেয়ে পাঠানো হচ্ছে। ঘটনাটিকে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক বলে বর্ণনা করে কঠোরতম শাস্তির কথা বলেন তিনিও।
অপরাধীরা ধরা পড়বে, শাস্তি হবে এ সবেরও আগে মুম্বই একটা কথা ভেবে চলেছে। সেটা হল, মুম্বইয়েও এমনটা ঘটল কী ভাবে এবং কেন! সোনম কপূর থেকে সুনিধি চৌহান বা সুরকার বিশাল ডাডলানি থেকে অভিনেত্রী টিসকা চোপড়া সকলের কথাতেই ফুটে বেরিয়েছে এই বিস্ময়! ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকারের হাতে আমলা-কন্যার খুন বা কয়েক বছর আগে বর্ষশেষের রাতে জুহুতে যৌন হেনস্থা বা হোটেলের ঘরে উঠতি অভিনেত্রীকে ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো মুম্বইয়ের ক্ষেত্রে কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা হয়েই থেকে গিয়েছিল। রাস্তাঘাটে কাজে বেরিয়ে মেয়েরা ধর্ষিত হবে, এমনটা চট করে ভাবতে পারতেন না মুম্বইকররা। এ বার থেকে অবশ্য ভাববেন। ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাসে জড়ো হওয়া সাংবাদিকদের প্রতিবাদ-অবস্থান সে কথাই বুঝিয়ে দিচ্ছিল। মুম্বই পুলিশ কমিশনার সত্য পাল সিংহ বলছিলেন, এখন থেকে মহিলা সাংবাদিকরা আগাম পুলিশি নিরাপত্তার সাহায্য চেয়ে রাখতে পারবেন।
ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস (সিএসটি)-এর সামনে বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স।
মুম্বই ‘চাওল’ নিয়ে খবর করতে গিয়েই তো বৃহস্পতিবার এমন বিপদের মুখে পড়লেন তরুণীটি। একটি ইংরেজি পত্রিকায় শিক্ষানবিশি করছিলেন। অফিস থেকে এক কিলোমিটার দূরে মহালক্ষ্মী এলাকার পরিত্যক্ত শক্তি মিলস চত্বরে ছবি তোলার পৌঁছে গিয়েছিলেন সন্ধে ছ’টার আগেই। তরুণীর বয়ান অনুযায়ী, কারখানায় ঢোকার মুখেই একটা লোক এগিয়ে আসে। প্রথমে প্রশ্ন করে, কার অনুমতি নিয়ে ওঁরা ছবি তুলছেন। তার পর তরুণীর সহকর্মীকে দেখিয়ে বলে, কিছু দিন আগে কারখানায় একটি খুন হয়েছে। এ-ই সেই খুনি। ছেলেটি বলেন, তিনি খুনি নন। তিনি এই প্রথম এই কারখানায় এলেন। লোকটি তখন আর এক জনকে ফোন করে। সে-ও এসে বলে, তরুণীর সহকর্মীই খুনি। এর পর শুরু হয় তাঁকে বেল্ট দিয়ে বেঁধে মারধর। তার পর তরুণীকে টেনেহিঁচড়ে একটু দূরে নিয়ে যায় তারা। ডেকে নেয় আরও তিন জনকে। পাঁচ জন মিলে ধর্ষণ করার পরে মেয়েটিকে অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে রেখে পালিয়ে যায় তারা। রাত ৮টা নাগাদ জ্ঞান ফেরে তরুণীর। তিনিই গিয়ে সহকর্মীর বাঁধন খোলেন। তার পর নিজেরাই চলে যান চার কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে। ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণ প্রমাণ হওয়ার পরে হাসপাতালই খবর দেয় পুলিশকে।
শুক্রবার ধরা পড়ে এক অভিযুক্ত। ধৃতের নাম আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশ করা হয়নি। যদিও এক অফিসার জানিয়েছেন, ধৃত ব্যক্তির নাম মহম্মদ আব্দুল ওরফে চাঁদ। তাঁর দাবি, অপরাধ স্বীকার করার পর ধৃতই জানিয়েছে বাকি অভিযুক্তদের নাম বিজয় যাদব, কাশিম বাঙালি, সালেম ও আশফাক।

ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ ঠেকাতে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়াটা একটা বড় কাজ। তার চেয়েও বড় কাজ হল আমাদের মানসিকতার বদল ঘটানো। আমাদের ছেলেদের এমন ভাবে শিক্ষা দিতে হবে যাতে মহিলাদের সম্মান দেওয়াটা তাদের চরিত্রের ভিতরেই ঢুকে যায়। তারা যাতে বুঝতে পারে যে, কোনও মহিলাকে পণ্য হিসেবে দেখাটা শুধু সেই মহিলা নয়, তথাকথিত পুরুষতন্ত্রের পক্ষেও অসম্মানের।
এ রকম একটা ঘটনা মুম্বই শহরের জন্য লজ্জা আর অপমানের। এক দিন আগেই তো রাখি উৎসব গেল, যেখানে মেয়েদের সঙ্গে বোন হিসেবে বন্ধন তৈরি হয়।
প্রিয় মুখ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ কমিশনার এবং মন্থর বিচারবিভাগ...আপনারা যদি রোজকার সাধারণ মেয়ে হতেন, ভাল হতো! ভয়টা অনুভব করতেন!
অপরাধীদের সবার চোখের সামনে শাস্তি দেওয়া হোক।
দেখাই যাচ্ছে, টুইটারে রাগ প্রকাশ করে কোথাও কোনও বদল আসেনি!
খুব কম করে বললে অসহায় লাগছে। বিধ্বস্ত, বিরক্ত ইত্যাদি শব্দ এই সময়ে কোনও অর্থ তৈরি করে না।
আট মাস ধরে অপেক্ষা করা নয়। অনেক অজুহাত শোনা গিয়েছে। আর নয়। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শাস্তি দিতেই হবে।
ইয়ে মেরা ইন্ডিয়া। ইয়ে মেরা মুম্বই। আর একটা গণধর্ষণ। জাতির জীবনে স্রেফ আর একটা দিন।
মেয়েদের প্রতি সহানুভূতি না দেখিয়ে যত ক্ষণ না তাদের সম্মান করতে শিখব, এমন হতেই থাকবে।
বিরক্ত, বিরক্ত, বিরক্ত। আমাদের তথাকথিত ‘নিরাপদ’ মুম্বইয়ে বিকেলবেলা এ রকম ঘটে গেল!!
মুম্বই?? ভাবতে পারছি না! আমরা কি এখনও শুধু কথাই বলতে থাকব?

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.