‘নূপুর খাতুন’।
অসংলগ্ন কথাবার্তায় পুলিশের কাছে কোনও রকমে নিজের নামটা বলেছিল বছর কুড়ির যুবতীটি। তারপর থেকেই তাঁর ঠাঁই হয়েছিল সরকারি হোমে। পরে জানা যায়, যুবতী মানসিক ভারসাম্যহীন। বিড়ম্বনায় পড়েন হোম কর্তৃপক্ষ। কারণ হোমটি আদতে সামাজিক সমস্যাগ্রস্ত মহিলাদের জন্য। সেখানে বিনা খরচে থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে ওই সব মেয়েদের স্বনির্ভর করে তোলা হয়। মানসিক রোগীদের রাখার মতো পরিকাঠামো সেখানে নেই। তা সত্ত্বেও রামপুরহাট হাসপাতালে ওই যুবতীর মানসিক রোগের চিকিৎসা শুরু করেন হোম কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বর্তমানে ওই হাসপাতালে চিকিৎসক না থাকায় চিকিৎসা হচ্ছে না যুবতীটির। এ দিকে যুবতীটিকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর জন্য প্রশাসনের সর্ব স্তরে আবেদন করেও সাড়া মিলছে না বলে অভিযোগ। ফলে নূপুরকে নিয়ে এক বিচিত্র সমস্যার মুখে হোম কর্তৃপক্ষ।
এই চিত্র রামপুরহাটের নিশ্চিন্তপুর এলাকার সরকারি হোম পুষ্পরাগ নিকেতনের। নলহাটির জ্যেষ্ঠা গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশ গ্রামের মধ্যে ওই যুবতীকে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরতে দেখে পুলিশে খবর দেন। পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে ওই হোমের হেফাজতে দেয়। মানসিক অসুস্থতার কথা ধরা পড়ার পরে রামপুরহাট হাসপাতালের মানসিকরোগ বিশেষজ্ঞ প্রসেনজিৎ রায়ের কাছে নূপুরকে দেখানো হয়। হোমের অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট সোমনাথ প্রামাণিক বলছেন, “ওষুধ খেয়ে নূপুরের কথাবার্তা ও স্বভাবে উন্নতি লক্ষ করা গিয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পরেই প্রসেনজিৎবাবু কাজ ছেড়ে দেওয়ায় নূপুরের চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়।”
এ দিকে মানসিক রোগীদের রাখার মতো পরিকাঠামোও ওই হোমে নেই। হোমের সম্পাদক সত্যব্রত ভট্টাচার্যের সংশয়, “নূপুর একজন মানসিক রোগী হওয়ায় না পারবে পড়াশোনা করতে, না পারবে কাজ শিখতে। এমন একজনের পুর্নবাসন আমরা কী ভাবে করব?” তাঁর দাবি, “বারবার হোমের তরফে প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েও কোনও সুরাহা হচ্ছে না। নূপুরকে নিয়ে আমরা চিন্তায় আছি।” সম্প্রতি প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে বর্ধমানের কাটোয়া লাগোয়া খাজুরডিহি এলাকার একটি হোমের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছিল। হোমের সুপার তাপসী সালুই বলেন, “সেখানেও আমাদের বলা হয় তাঁরা নূপুরকে আশ্রয় দিতে পারবেন না। কারণ, ওখানে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত মেয়েদেরই রাখা হয়।” ফলে সব অসুবিধা সত্ত্বেও নূপুর এখনও ‘পুষ্পরাগ নিকেতন’ হোমেই রয়েছেন।
সমাজকল্যাণ দফতরের জেলা আধিকারিক প্রদীপকান্তি কুমার আবার বলছেন, “হোম কর্তৃপক্ষ তো জানিয়েছিলেন, ওই যুবতী ওখানে ঠিকই আছেন। এমন অবস্থা হলে হোম কর্তৃপক্ষকে ফের একটি আবেদন করতে হবে। তবেই আমরা কিছু করতে পারব।” অন্য দিকে, নূপুরের কথা জানতে পেরে রামপুরহাটের মহকুমাশাসক রত্নেশ্বর রায়ের প্রতিক্রিয়া, “ওই যুবতী যখন মানসিক রোগী তখন তাঁকে অন্যত্র রাখার ব্যবস্থা তো করতেই হবে। দ্রুত খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
এমন পরিস্থিতিতে নূপুর আপাতত হোমের বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটি করেই দিন কাটাচ্ছে। আপন মনে চিৎকার করে নিজের দাবি বুঝিয়ে দিতে সে ভালবাসে। তবে হোমে থাকা অন্যান্যদের পরিবারের লোকজন আসলেই তাঁদের কাছে ছুটে চলে আসে নূপুর। ভাবে এই বুঝি কেউ তাঁকে বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছে। হোমের কর্মীরা জানাচ্ছেন, যখন বুঝতে পারে ওঁরা তাঁর কেউ নন, তখন একছুট্টে নিজের ঘরে ফিরে যায়। শুরু হয় গুমরে গুমরে কান্না।
আর ঠিক কত দিন, জানেন না হোম কর্তৃপক্ষ। তবে এ ভাবেই দিন কাটছে নুপূরের। |