ক’মাসেই লিখতে পারছে শূন্য-পাওয়া পড়ুয়ারা |
শিক্ষার অধিকার আইন কার্যকর হওয়ার পরে শিক্ষা দফতর ও সরকার বেশ নড়েচড়ে বসেছে। সম্প্রতি উচ্চ বিদ্যালয়গুলির প্রধান শিক্ষকদের নিয়ে তিন দিন ধরে কর্মশালা অনুষ্ঠিত হল সর্বত্র। উদ্দেশ্য, ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সের (৬ থেকে ৯ বছর পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরের জন্য) স্কুলছুট ছেলেমেয়েরা যদি আবার বিদ্যালয়ে পড়তে আসে তা হলে কী ভাবে তাদের অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের সমমানে উন্নীত করা হবে তারই কৌশল নিয়ে আলোচনা।
ধরে নেওয়া হয়েছে, যারা ‘ড্রপ-আউট’ হয়েছে এখন তাদের সাধারণ রিডিং পড়া বা সহজ অঙ্ক করার সামর্থ্য নেই। ফলে তাদের জন্য তিন-চার মাস পৃথক একটি পঠনপাঠন পদ্ধতি অনুসরণ করে বয়সোপযোগী সক্ষমতা তৈরি করে পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে পড়ার সুযোগ করে দিতে হবে। ড্রপ-আউট ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার মান এ রকমই হবে, এ বিষয়ে কোনও বিতর্ক নেই। তারা বয়সোপযোগী ক্লাসে ভর্তি হলে অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের মতো নির্দিষ্ট সিলেবাস ধরে পড়তে পারবে না, সেটাই স্বাভাবিক। তা হলে তাদের জন্য কী করা সম্ভব? |
তার উত্তর খুঁজতে কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলাম আমরা। গ্রামের গরিব এলাকায় আমাদের বিদ্যালয়। ২০০৯ সাল থেকে এই বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পরে পড়ুয়াদের শিক্ষার মান যাচাই করার জন্য ১০ নম্বর করে বাংলা, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে অতি সাধারণ মোট ৩০ নম্বরের পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করি। এই বছর ১২৭ জন পরীক্ষা দিয়েছিল, তার মধ্যে ২৮ জন অনেক কষ্ট করে কেবল নিজের নামটুকু লিখেছে। বাবার নাম, গ্রামের নাম, যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ত তার নাম, কিছুই লিখতে পারেনি। সাধারণ যোগ-বিয়োগও কিছু শেখেনি।
গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখছি, গড়ে শতকরা ৩০ ভাগ পড়ুয়া চতুর্থ শ্রেণির গণ্ডি অতিক্রম করলেও তাদের মান শূন্যস্তরে। এদের মধ্যে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস করে দেখেছি, প্রায় ৯০ ভাগ অনগ্রসর তফসিলি জাতি-জনজাতি বা মুসলিম শ্রেণিভুক্ত। এদের বাবা-মা লেখাপড়া প্রায় জানেন না। আমরা পরীক্ষার পরে সকল অভিভাবককে ডেকে আলোচনা করি। এমন মান নিয়ে কী ভাবে এরা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আসছে, সে সম্পর্কে কারণ অনুসন্ধানের জন্য স্থানীয় প্রাথমিক শিক্ষক মহাশয়দের সঙ্গেও আলোচনা করি।
আমরা লক্ষ করি, এই শূন্যমানে থাকা পড়ুয়াদের যখন সাধারণ পড়ুয়াদের সঙ্গে তাদের শ্রেণির সিলেবাস পড়ানো হয়, এরা কোনও কিছুই বুঝতে পারে না। দিনের পর দিন এ ভাবে তারা বাধ্য হয়ে ক্লাসঘরে আটকে থাকে। স্বাভাবিক ভাবেই পড়ার প্রতি আগ্রহ নষ্ট হয়। আর প্রতিটি পরীক্ষাতেই এরা শূন্য পায়, শিক্ষকদের বকুনি খায়, ‘মাথামোটা, তোদের কিস্সু হবে না’ জাতীয় মন্তব্য শোনে। এ ভাবে একই ক্লাসে দু’তিন বছর থাকার পরে লজ্জায় স্কুলে আসার আগ্রহ হারিয়ে স্কুলছুট হয়। এখন অবশ্য ‘নো ডিটেনশন’ নীতি চালু হয়েছে। ফলে শূন্যস্তরের মান নিয়েই এরা অনেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সকলের অগোচরে পৌঁছে যায় মিড-ডে মিল খেতে খেতে।
গত কয়েক বছর ধরেই পিছিয়ে-পড়া পড়ুয়াদের গোড়ার দু’তিন মাস বর্ণপরিচয়, ধারাপাত, ইংরেজির অক্ষর পরিচয় প্রভৃতি পড়ানোর ব্যবস্থা করি আমরা। পরিকাঠামোর অনেক সমস্যা নিয়েই এই কাজ করি। দেখা যায়, ওই সব পড়ুয়া অনেকটাই শিখতে পারছে এবং পরে তাদের শ্রেণির পাঠ্যসূচির মধ্যে যুক্ত করার ফলে তাদের প্রাথমিক অসুবিধাগুলি থাকছে না। এ বিষয়ে অভিভাবকদেরও সহযোগিতা পাওয়া যায়। |
কেন প্রাথমিক স্তরে ৪-৫ বছর থাকার পরেও পঞ্চম শ্রেণিতে এমন প্রায়-নিরক্ষর পড়ুয়া আসছে, এর যথাযথ উত্তর দিতে হলে বহু শিক্ষক সমালোচনায় মুখর হবেন জানি। এ কথা ঠিকই যে, এখনও পর্যন্ত সব প্রাথমিক স্কুলে প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। পঠন-পাঠন ছাড়াও একাধিক কাজে শিক্ষকদের যুক্ত থাকতে হয়। বহু প্রাথমিক শিক্ষক মহাশয়ের সঙ্গে আলোচনা করে কিছু গতানুগতিক সমস্যার কথা জেনেছি। বিশেষ করে অনেকেই বলেছেন, বাড়িতে একেবারে পড়াশুনা না-করা বা পিতা-মাতার লেখাপড়া না-জানায় এমন পড়ুয়াদের এই অবস্থা হচ্ছে।
তার মধ্যেও আত্মসমালোচনা করে অনেকে বলছেন, আমাদের দায়িত্ব অর্থাৎ শিক্ষকদের দায়িত্বই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। শিক্ষকদের কাজের মূল্যায়ন করার কেউ নেই। সরকারি শিক্ষক হিসাবে অনেক সুযোগ আমাদের দায়বদ্ধতাকে ভুলিয়ে দিচ্ছে। মাত্র দু’তিন হাজার টাকা বেতন পেয়ে পাশাপাশি গজিয়ে ওঠা বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলিতে যে-মানের পঠন-পাঠন হচ্ছে, তুলনায় সরকার-পোষিত স্কুলগুলি ব্যর্থ হচ্ছে প্রধানত কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন শিক্ষকের জন্য।
গ্রামাঞ্চলে তাই দ্রুত মানুষের আস্থা হারাচ্ছি আমরা। যদিও এখনও এমন বহু শিক্ষক আছেন যাঁরা যথেষ্ট দায়বদ্ধ এবং সেখানে ফলও অন্য রকম হচ্ছে অন্যান্য সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও। শিক্ষার অধিকার আইনের অর্থ যদি আমরা এ ভাবে করি যে, ৬ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত পড়ুয়াদের যে ভাবেই হোক কেবল বিদ্যালয়ে ধরে রাখব অথচ তার গুণগত মান অবহেলিত থাকবে, তা হলে আইনের সামাজিক উদ্দেশ্য ব্যর্থই হবে। এ বিষয়ে কোনও আপস না করে সরকারকে কঠোর হতেই হবে।
|
লেখক হরিপালে জামাইবাটি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক
|