মরণ রে তুহুঁ মম শ্যাম সমান... এ কথা কবিতায় পড়া চলত। কিন্তু স্বেচ্ছায় সেই মরণকে ডেকে আনতে চাওয়া ছিল দণ্ডনীয় অপরাধ।
এ বার আইন বদলাচ্ছে। আত্মহত্যাকে অপরাধের তকমা থেকে মুক্ত করতে চাইছে কেন্দ্র।
বুধবার রাজ্যসভায় পেশ হয়েছে ‘মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা বিল, ২০১৩’। এই নতুন বিলের ১২৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে আত্মহত্যা অপরাধ নয়। দণ্ডবিধি যা-ই বলুক, অন্য কোনও উদ্দেশ্যের প্রমাণ ছাড়া আত্মহত্যায় উদ্যত ব্যক্তিকে মানসিক ভাবে অসুস্থ বলেই গণ্য করতে হবে। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৯ নম্বর ধারায় তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে না।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের আনা এই বিল সংসদে পাশ হয়ে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেয়ে আইনে পরিণত হলেই আত্মহত্যাকে আর অপরাধ বলা যাবে না। আত্মহত্যার চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়া বা আত্মহত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়া কাউকে আর গারদে পোরা যাবে না। কেন্দ্রীয় সরকার সূত্রের খবর, ভবিষ্যতে ভারতীয় দণ্ডবিধি সংশোধন করে ৩০৯ নম্বর ধারাটি বাতিল করারও পরিকল্পনা রয়েছে। কেন্দ্রীয় আইন কমিশনের পক্ষ থেকে ওই আইন সংশোধন করার জন্য প্রস্তাব করা হবে। তার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
আত্মহত্যাকে অপরাধ বলে গণ্য করা উচিত কি না, তা নিয়ে অনেক বারই সংশয় প্রকাশ করেছে আদালত। ১৯৮৭ সালে বম্বে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ রায় দেয়, ৩০৯ নম্বর ধারা অসংবিধানিক এবং বৈষম্যমূলক। এটি সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারা (আইনের চোখে সাম্যের অধিকার) ও ২১ নম্বর ধারার (জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার) বিরোধী। ১৯৯৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, আত্মহত্যার চেষ্টাকে অপরাধ বলা যায় না। সংবিধানের ২১ নম্বর ধারায় জীবনের অধিকারের মধ্যেই মৃত্যুর অধিকারও ঢুকে রয়েছে। তবে ১৯৯৬ সালে গিয়ান কৌর বনাম পঞ্জাব সরকার মামলায় সুপ্রিম কোর্টেরই পাঁচ সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ আগের দু’টি রায় খারিজ করে দেয়।
কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অধিকার ও মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, আত্মহননের পথে পা রাখার জন্য কাউকে অপরাধী বলে দেগে দেওয়া
ঠিক নয়। বরং সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে তাকে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। নতুন বিল সেই দাবিই মেনে নিল। |
অর্থাৎ? জনপ্রিয় বাংলা ছবি ‘হেমলক সোসাইটি’র আত্মহত্যাপ্রবণ নায়িকা কোয়েল মল্লিকের কথা মনে পড়তে পারে। অথবা জীবনানন্দের কবিতা ‘আট বছর আগের এক দিন’! ‘...যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ, মরিবার হল তার সাধ...’ আইনের চোখে এ সবই ছিল দণ্ডনীয় অপরাধ। নতুন বিল বিষয়টাকে অন্য ভাবে দেখার কথা বলছে। যদিও মেডিকো-লিগাল বিশেষজ্ঞ তথা আইনজীবী শেখর বসুর প্রশ্ন, “যে জীবন প্রকৃতির দান, তা নিজে হাতে শেষ করার অধিকার দেওয়া যায় কি?”
রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান তথা সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “একটা লোক কোনও চরম পরিস্থিতিতে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে নিজের প্রাণ শেষ করতে চায়। একে অপরাধের পর্যায়ে ফেলা ঠিক নয়।” মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মী কিরীটি রায়ের মত, “আত্মহত্যার চেষ্টা মানুষের চূড়ান্ত মানসিক অবসাদের বহিঃপ্রকাশ। তাঁকে হাজতে ঢোকানোটা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক, অমানবিক।”
স্বাস্থ্য মন্ত্রক দাবি করছে, মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারের দিক থেকেও নতুন বিলটি তাৎপর্যপূর্ণ হতে চলেছে। কারণ এখানে আত্মহত্যায় উদ্যত ব্যক্তিকে মানসিক ভাবে অসুস্থ বলে ধরে নিয়েই হাত গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে না। তার চিকিৎসার উপরেও সমান জোর দেওয়া হচ্ছে এবং তার অনেকটা দায়িত্ব সরকার নিজের কাঁধে নিচ্ছে। বিলে মানসিক স্বাস্থ্য নজরদারি সংস্থা গড়ে তোলা এবং রিভিউ কমিশন গড়ার প্রস্তাব রয়েছে। তার সঙ্গে মানসিক রোগের চিকিৎসায় রোগীর সঙ্গে অমানবিক আচরণ বন্ধে নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়ের আশা, এই আইন মানসিক রোগ আর বৈকল্যের (ডিসঅর্ডার) মধ্যে তফাৎটা সমাজকে মনে করিয়ে দেবে এবং তার শুশ্রূষার উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তুলবে। |
কেউ কেউ অবশ্য একটা প্রশ্ন তুলছেন। ভারতে আত্মহত্যার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। সেখানে নতুন আইন আত্মহত্যার প্রবণতাকে পরোক্ষে উৎসাহ দিয়ে বসবে না তো? “ভয় দেখিয়ে আত্মহত্যা আটকানোর একটা অস্ত্র কিন্তু কমলো,” আশঙ্কাটা উড়িয়ে দিচ্ছেন না ‘হেমলকে’র পরিচালক সৃজিৎ মুখোপাধ্যায়। মনোবিদরা অবশ্য বলছেন, অপরাধী তকমা দিয়ে আত্মহত্যা ঠেকানো যাবে না। বরং সঠিক চিকিৎসাই পারে মুক্তির দিশা দিতে। মনোবিদ মোহিত রণদীপ বলেন, “কোনও মানুষ আত্মহত্যায় ব্যর্থ হলে এমনিতেই তাকে এবং তার বাড়ির লোককে লজ্জা ও অস্বস্তিতে পড়তে হয়। তখন পুলিশ এবং আইনি ঝামেলা অবস্থা আরও জটিল করে।” মনশ্চিকিৎসক মলয় ঘোষাল তাই আশাবাদী, “এখন কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করলে আইন-পুলিশ এড়াতে মানুষ ঘটনাটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। ফলে অনেক রোগীকেই চিকিৎসকের কাছে আনা হয় না। নতুন আইন হলে সেটা হয়তো বদলাবে।” |