ফের দরজায় কড়া নাড়ছে পুরভোট। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা ফের পরিষেবা নিয়ে পুরবাসীদের সমস্যার সমাধানের প্রতিশ্রুতি নিয়ে দরজায় দরজায় হাজির হবেন। কিন্তু তার পরেও যে সমস্যা মিটবে না গত কয়েকটি ভোটের পরে তা বুঝে গিয়েছেন হাবরাবাসী। তাই এ বারও যে তার ব্যতিক্রম হবে না তা ভালই জানেন তাঁরা।
উত্তর ২৪ পরগনার এই শহরের যানজট নিয়ে বাসিন্দাদের সমস্যা দীর্ঘদিনের। শহরের বুক চিরে চলে গিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ৩৫ নম্বর জাতীয় সড়ক যশোহর রোড। যা পৌঁছেছে পেট্রাপোলে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত। ভারত-বাংলাদেশ বাস চলাচল শুরু হওয়ার পরে হাবরা শহরের যানজটে পড়ে বাসযাত্রীদের যাতে ভুগতে না হয় সে জন্য বিভিন্ন সময় প্রশাসনের তরফে নানা পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু অদ্ভূতভাবে পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয়নি। শহরের মধ্যে ১ নম্বর রেলগেট থেকে চোংদা মোড় পর্যন্ত মাত্র তিন কিলোমিটার পথ পার হতেই গাড়িতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। কখনও কখনও তা আরও দীর্ঘ হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, যানজটের মূল কারণ অপরিসর রাস্তা। যার দু’দিক চলে গিয়েছে হকারদের দখলে। |
ভোট এলে রাজনৈতিক দলগুলি যানজট সমস্যার সমাধানে হকার সরিয়ে রাস্তা চওড়া করার কথা বলে। কিন্তু ভোট মিটে গেলে ভোটের স্বার্থেই হকার সরানোর কথা ভুলে যায়। ফলে তাঁদের অবস্থা থেকে যায় সেই তিমিরেই।
২০০৮ সালে পুর নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরে গত পাঁচ বছরে যানজট সমস্যা মেটাতে উদ্যোগী হয় তৃণমূল। পুলিশ-প্রশাসন থেকে ব্যবসায়ী সংগঠন সমস্ত পক্ষকে নিয়ে বেশ কয়েকটি বৈঠক করা হয়। নেওয়া হয় কিছু সিদ্ধান্তও। পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে পুর কর্তৃপক্ষ রাস্তায় নেমে যশোহর রোডের দু’পাশের ফুটপাথকে কমবেশি হকারমুক্ত করে। দুঘর্টনা রোধে রাস্তার মাঝে বসে গার্ডরেল। চালানো হয় বেআইনি গাড়ি, ভ্যানের বিরুদ্ধে অভিযান। কিন্তু অভিযানের কয়েকদিন বাদ দিলে ফের আগের অবস্থায় ফিরে গিয়েছে হাবরা শহর। বাসিন্দাদের বক্তব্য, স্থায়ী সমাধান না করে শুধুমাত্র এ ধরনের অভিযান চালিয়ে যে সমস্যার সমাধান করা যাবে না তা কি প্রশাসন জানে না? তাঁদের দাবি, এলাকার যানজটের সমস্যা মেটাতে গেলে উড়ালপুল তৈরি করতে হবে নয়তো রাস্তার দু’পাশ হকারমুক্ত করে তা চওড়া করতে হবে।
স্থানীয় বিধায়ক ও রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক যানজট সমস্যায় সমাধানে এলাকায় উড়ালপুল তৈরির জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন। তাঁর কথায়, “রাজ্য সরকার ও রেল যৌথভাবে শহরে দু’টি উড়ালপুল তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৩২ কোটি টাকা। যার অর্ধেক ইতিমধ্যেই দিয়ে দিয়েছে রাজ্য। উড়ালপুল তৈরির জন্য মাটি পরীক্ষার কাজও শেষ হয়ে গিয়েছে। নির্মাণের কাজ করবে রেল। এটা তৈরি হলে যানজট সমস্যা মিটিয়ে ফেলা যাবে।”
বছরের পর বছর যানজটের সমস্যা না মেটার জন্য এলাকার মানুষের অভিযোগের তির বামেদের দিকেও। তাঁদের বক্তব্য, ২০০৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পুরবোর্ড ছিল বামেদের। কিন্তু শুধু প্রতিশ্রুতি দেওয়া ছাড়া কোনও কাজই হয়নি। তৎকালীন পরিবহণ মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী হাবরায় উড়ালপুল তৈরির কথা বলেছিলেন। দু’কিলোমিটার দীর্ঘ ওই উড়ালপুল তৈরিতে ১৩০ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছিল। বলা হয়েছিল উড়ালপুল তৈরির পাশপাশি অন্যান্য উন্নয়নও করা হবে। কিন্তু সে সব আর হয়নি।
হাবরার বিদায়ী পুরপ্রধান তপতী দত্ত বলেন, “যানজট সমস্যা মেটাতে পুরপ্রশাসন কিছু করছে না এমন অভিযোগ ঠিক নয়। যশোহর রোডের দু’ধারে থাকা নিকাশি নালা দখল করে তৈরি হওয়া দোকানপাট সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শহরের মধ্যে যাতায়াত করা অটো, ভ্যান, ট্রেকারের জন্য স্ট্যান্ড তৈরি করা হয়েছে। তা ছাড়া, হকারদের জন্য ১ নম্বর রেলগেট এলাকায় একটি চারতলা মার্কেট তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। পাশাপাশি বিধায়ক তহবিলের টাকায় জয়গাছি সুপার মার্কেটে আরও একটি হকার মার্কেট তৈরি করা হবে।”
যদিও বিরোধী দলনেতা সিপিএমের ঋজিনন্দন বিশ্বাসের দাবি, “শুধু একের পর এক বৈঠক করা ছাড়া হাবরার যানজট সমস্যা মেটাতে উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি পুরকর্তৃপক্ষকে। তার প্রমাণ, এখনও শহরের মানুষকে নিত্য যানজটের কবলে পড়ে নাজেহাল হতে হচ্ছে। কাজ বলতে যা হয়েছে তা হকার মার্কেট। যদিও সে ক্ষেত্রেও আমাদের সহযোগিতা রয়েছে।”
পুরপ্রধান ও বিরোধী দলনেতার চাপানউতোরে অবশ্য নিজেদের সমস্যার আশু সমাধান দেখতে পাচ্ছেন না হাবরার মানুষ। এক প্রবীণ বাসিন্দার কথায়, “পথে বেরিয়ে রোজ যে নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হয় তা সয়ে গিয়েছে। দিনের পর দিন মিথ্য প্রতিশ্রতি পেতে পেতে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে ভাল কিছু পরিবর্তনের আশা করি না। যদিও এবারও ভোট দেব।” নির্বাচনের পরে নতুন পুরবোর্ড এই প্রবীণের মতো সকল হাবরাবাসীকে যানজটের সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারেন কি না, সেটাই দেখার। |