মেয়াদ কমেছিল আগেই। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা ও সহযোগী দলের নেতারা পাহাড়ের জনতার কাছে ‘ঘরে বসে থাকা’-র আর্জি পাঁচ দিন থেকে কমিয়ে ২৪ ঘণ্টায় নামিয়েছিলেন। সোমবার তাতে পাহাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ সাড়া দিলেও, চোখে পড়েছে উল্টো ছবিও। বিজনবাড়ি, সুখিয়াপোখরি, সুকনার মতো এলাকায় অল্প হলেও কিছু বাসিন্দাকে রাস্তায় দেখা গিয়েছে। সুকনার ছাত্রছাত্রীরা তো আর পাঁচটা দিনের মতো শিলিগুড়ির স্কুল-কলেজেও গিয়েছে। অন্য দিকে, গোর্খাল্যান্ডের বিরোধিতায় একটি সংগঠন বন্ধের ডাক দিলেও, জনজীবনে তার আঁচ পড়েনি। সব মিলিয়ে, বন্ধ নিয়ে পাহাড়-সমতলে অসহিষ্ণুতা যে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তা সব পক্ষের কাছেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
গোর্খাল্যান্ড জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি অবশ্য এ দিন দাবি করেছে, ওষুধ কেনা, হাসপাতালে যাওয়া ইত্যাদি জরুরি কারণে অনেকে বাড়ির বাইরে বেরোলেও, আম জনতা আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। |
তা সত্ত্বেও মোর্চার কোণঠাসা হওয়ার আশঙ্কা যে বাড়ছে, তার ইঙ্গিত মিলেছে। আন্দোলনের শুরুতে গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিটিএ) ছাড়ার হুমকি দিয়ে চিফ একজিকিউটিভ পদ ছেড়েছিলেন বিমল গুরুঙ্গ। কিন্তু তার পর থেকেই তাঁর মনোনীত প্রার্থীকে সেই পদে বসানোর মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন মোর্চা নেতারা। সরকারি সূত্রের খবর, বিমল গুরুঙ্গ সরকারকে চিঠি লিখে মোর্চার তরফে মনোনীত সদস্যকে পরবর্তী চেয়ারম্যান করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এ নিয়ে জিটিএ-র প্রধান সচিব রামদাস মিনা এবং দার্জিলিংয়ের জেলাশাসক পুনীত যাদবের সঙ্গে মহাকরণে সোমবার দীর্ঘ বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্র সচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও দেখা করেন রামদাস মিনা। আজ, মঙ্গলবার, জিটিএ-র নতুন চেয়ারম্যান কে হবেন তা ঠিক করবেন রাজ্য সরকার।
এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে মোর্চার সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজু প্রধান বলেন, “চিফ পদে কে বসবেন তা নিয়ে দলে সিদ্ধান্ত হয়েছে।” |
তিনি কোনও নাম প্রকাশ্যে বলতে রাজি না হলেও মোর্চা সূত্রে খবর, জিটিএ-তে মোর্চার মনোনীত সদস্য বিরখু ভূষালকে ‘চিফ’ পদে বসানোর জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। প্রায় ৮৫ বছর বয়সী বিরখু ভূষাল পেশায় দর্জি। দার্জিলিঙের দারোগাবাজার এলাকার বাসিন্দা বিরখুবাবু সমাজসেবী ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের নেতা হিসেবে পরিচিত। তিনি তফসিলি জাতি ও জনজাতি সংগঠনের সর্বভারতীয় সংগঠন ও মোর্চার দার্জিলিং মহকুমা কমিটির সহ- সভাপতি পদে রয়েছেন। সমাজ সেবার জন্য ‘অম্বেডকর সম্মান’ও পেয়েছেন তিনি।
মোর্চার একটি সূত্রের দাবি, বিমল গুরুঙ্গের জায়গায় নির্বাচিত কোনও জিটিএ সদস্যকে ‘চিফ’ করা হবে না বলে দলের তরফে ঠিক করা হয়েছে। তাতে জিটিএ-তে থাকা নিয়ে বিরোধী পক্ষ কোনও প্রশ্ন তুললে সরাসরি মোর্চার উপরে আঁচ পড়বে না। উপরন্তু, পাহাড়ের অন্যতম প্রবীণ ব্যক্তিত্বকে বসালে বিদ্বজ্জন ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের সমর্থনও বাড়বে বলে আশা করছে মোর্চা। তবে পাহাড়ে মোর্চার সমালোচকদের অনেকের অভিযোগ, অশীতিপর নেতাকে ‘চিফ’-এর আসনে বসিয়ে আড়াল থেকে বিমল গুরুঙ্গই সিদ্ধান্ত নেবেন।
এক দিকে জিটিএ-র নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে, অন্য দিকে গোর্খাল্যান্ডের জন্য আন্দোলন জারি রেখে মোর্চা নেতারা পরিস্থিতির রাশ হাতে রাখতে চাইছেন। লাগাতার বন্ধের হয়রানিতে পাহাড়বাসী বিক্ষুব্ধ হচ্ছেন আন্দাজ করে দ্বিতীয় দফার ‘ঘরে বসে জনতা’ আন্দোলনকে ছেঁটে এক দিনে করেছেন মোর্চা নেতারা। আজ, মঙ্গলবার থেকে ‘বাইরে থাকবে জনতা’ নামে আন্দোলন হবে। মোর্চা সমর্থকেরা রাস্তায় নেমে আলাদা রাজ্যের দাবিতে মিটিং, মিছিল করলেও অবরোধ, ঘেরাও হবে না বলেই মোর্চার দাবি।
এ দিন মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি আবার রাজ্যের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের অভিযোগ করে বলেছেন, “দলের নেতাদের জেলে পুরে দিলে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার লোক থাকবে না বলে ভাবছে রাজ্য সরকার। কিন্তু পাহাড়ের জনতা এই আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।” কেন্দ্রের থেকে আলোচনায় বসার ডাক আশা করছে মোর্চা, তা-ও বলেন তিনি। সিপিএমের দার্জিলিং জেলা কমিটিও মোর্চার নেতাদের পুরনো মামলায় গ্রেফতারের সমালোচনা করেছে। প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য বলেন, “আমরা গোর্খাল্যান্ডের দাবির বিরোধী। কিন্তু একটা আন্দোলনের সময়ে এভাবে পুরনো মামলায় গ্রেফতার করাটা অগণতান্ত্রিক।” বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুও কলকাতায় সাংবাদিকদের বলেন, “আলোচনা ছাড়া পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আগে ওদের আলোচনায় ডাকা হোক।” তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “পাহাড় সমস্যা সমাধানে রাজ্য সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।” |