পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে বিভিন্ন কর্মীসভা বা জনসভায় সিপিএমের পাশপাশি কংগ্রেসকেও তাঁদের ‘রাজনৈতিক শত্রু’ হিসাবে চিহ্নিত করে প্রচারে নেমেছিল তৃণমূল। উত্তর ২৪ পরগনায় সিপিএম, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জোরদার প্রচার চালাতে দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন তৃণমূলের জেলা পর্যবেক্ষক ও রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। কিন্তু ভোটের পর বহু এলাকাতেই বোর্ড গঠনে ‘রাজনৈতিক শত্রু’ কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলাল তৃণমূল। এমনকী খাদ্যমন্ত্রীর বিধানসভা এলাকাতেও দেখা গিয়েছে এই ছবি।
ভোটের আগের অবস্থান কেন ভোটের পরে তাঁরা বজায় রাখতে পারলেন না?
জ্যোতিপ্রিয়বাবুর কথায়, “কংগ্রেসের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। ওরা বুঝতে পেরেছে সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে সমর্থন করতে হবে তৃণমূলকেই। আমরা চাই, সিপিএম বিরোধী লড়াই করতে প্রকৃত কংগ্রেসীরা তৃণমূলে যোগ দিন। আমরা তাঁদের স্বাগত জানাব।” তবে রাজনৈতিক মহলের মতে, খাদ্যমন্ত্রী যতই ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করুন, এটা তৃণমূলের দ্বিচারিতা ছাড়া কিছু নয়।
হাবরা-১ ব্লকের কুমড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ২৯টি আসনের মধ্যে তৃণমূল পেয়েছে ১০টি, কংগ্রেস ৪টি নির্দল ২টি এবং বামেরা পেয়েছে ১৩টি আসন। গত শনিবার ছিল বোর্ড গঠন। পঞ্চায়েত প্রধান নির্বাচনের জন্য ভোটাভুটিতে দেখা যায় তৃণমূল প্রার্থী রীতা দেবনাথ পেয়েছেন ১৬টি ভোট। বামপ্রার্থী পেয়েছেন ১৩টি ভোট। নির্বাচনের আগে এখানে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চরম আকার নেয়। যে দু’জন নির্দল হিসাবে ভোটে দাঁড়ান তাঁরা আসলে তৃণমূলের কর্মী হিসাবেই পরিচিত। স্থানীয় তৃণমূল নেত্রী তথা হাবরা-১ পঞ্চায়েত সমিতির আসনে এ বার জয়ী রত্না বিশ্বাসের উদ্যোগে ওই দুই জয়ী নির্দল জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের সঙ্গে দেখা করেন। হাবরা-১ পঞ্চায়েত সমিতির বিদায়ী সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, “ওই দুই নির্দল তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। সিপিএমকে ঠেকাতেই ওঁরা আমাদের নিঃশর্ত সমর্থন করেছেন।” যদিও দলের একাংশের ধারণা, পঞ্চায়েতে সঞ্চালকের যে ৪টি পদ রয়েছে, সেই চারটি পদই কংগ্রেসের চার জয়ী প্রার্থীকে দেওয়া হবে।
কুমড়া এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই কংগ্রেস শক্তিশালী। যার মূলে রয়েছেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা হামিদ মণ্ডলের প্রতি সাধারণ মানুষের প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। বিধানসভা নির্বাচনের আগে জ্যোতিপ্রিয়বাবু হাবরার প্রার্থী হয়ে তাঁর কাছে এসে আশীর্বাদ নিয়েছিলেন। হামিদসাহেবও খাদ্যমন্ত্রীকে স্নেহ করেন। সেই হিসাবে পঞ্চায়েত নির্বাচন ছিল সম্মানের লড়াই। জ্যোতিপ্রিয়বাবুর কথায়, “হামিদ সাহেব কখনওই সিপিএমকে সমর্থন করতে পারেন না। তাঁর ছেলে মুজিবরও বাবার পথ অনুসরণ করেছেন। তাঁর উদ্যোগেই এই প্রথম কুমড়া পঞ্চায়েত দখল করতে পারল তৃণমূল।” হাবরার বাসিন্দা ও জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ সমাদ্দার বলেন, “বামবিরোধিতা এবং এই এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে স্থানীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার বিরোধিতা করা হয়নি। তা ছাড়া বাধা দিলে দল ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।’’
আর কী বলছে সিপিএম?
হাবরার প্রাক্তন বিধায়ক সিপিএমের প্রণব ভট্টাচার্য বলেন, “এই জোট নীতিহীন। ব্যক্তি স্বার্থে এটা করা হয়েছে।” শুধু কুমড়া পঞ্চায়েতই নয়, রাউতারা পঞ্চায়েতেও একই ছবি। ২২টি আসনের মধ্যে তৃণমূল ১১টি, কংগ্রেস একটি এবং সিপিএম ১০টি আসন পায়। কংগ্রেস আগেই তৃণমূলকে সমর্থন করায় সিপিএম প্রধান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। হাবরা-২ পঞ্চায়েত সমিতির বেড়াবেড়ি পঞ্চায়েতে ১৭টি আসনের মধ্যে তৃণমূল ৪টি, কংগ্রেস ৬টি, নির্দল ১টি ও সিপিএম পায় ৬টি আসন। এখানেও প্রধান তৃণমূলের। উপপ্রধান কংগ্রেসের। অশোকনগরের তৃণমূল বিধায়ক ধীমান রায় বলেন, “সিপিএমকে ঠেকাতে আমরা কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথভাবে বোর্ড গঠন করেছি।” পরিস্থিতি কী হতে চলেছে তা আগে থেকেই আন্দাজ করে প্রার্থী দেয়নি সিপিএম। যদিও প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক সত্যসেবি কর বলেন, “আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাইনি। তাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিনি।”
বাগদা ব্লকের রণঘাট গ্রাম পঞ্চায়েতটি টসে জিতে দখল করেছে তৃণমূল। গাইঘাটা ব্লকের জলেশ্বর-১ এবং জলেশ্বর-২ পঞ্চায়েতে দু’টি টসে জিতে ক্ষমতায় এসেছে বামেরা। এই ব্লকের চাঁদপাড়া পঞ্চায়েতও সিপিএমের দখলে গিয়েছে। ফুলসরা পঞ্চায়েতে এক নির্দল সদস্যের উপরে বোর্ড গঠন আটকে ছিল। ভোটে বামেদের সমর্থন নিয়ে তিনি জয়ী হলেও পরে তৃণমূলকে সমর্থন করে প্রধান হয়েছেন। আবার ইছাপুর-২ পঞ্চায়েতে এর উল্টো ছবি দেখা গিয়েছে। এখানে এক নির্দল প্রার্থীর সমর্থনে বামেরা প্রধান নির্বাচনে লড়াই করে টসে হেরে যায়। যদিও ভোটের সময় ওই নির্দল প্রার্থীর হয়ে প্রচারে দেখা গিয়েছিল গাইঘাটার তৃণমূল বিধায়ক মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরকে। |