সাবধানীদের ভরসা ব্যাঙ্ক-ডাকঘরই
ভারতীয় অর্থনীতি যেন বহুছিদ্রযুক্ত জ্বরাজীর্ণ এক জলাধার। জলের স্তর ক্রমশই কমছে। সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছেন দেশি-বিদেশি সব শ্রেণির লগ্নিকারী। ছিদ্র সারাইয়ের কাজ সময় মতো হয়নি। ফলে ছিদ্র ভরাট হয়নি, বেড়েওছে সংখ্যায়। ‘গেল গেল’ রব ওঠার পর তড়িঘড়ি কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে, কিন্তু তা কোনও ফল দেয়নি। বরং ভুল বার্তা পাঠিয়েছে বিভিন্ন মহলে। এতে আরও শঙ্কিত হয়ে উঠেছে শেয়ার বাজার।
অর্থমন্ত্রীর স্তোকবাক্যে আশ্বস্ত বোধ করছেন না কেউ। তাঁর মতে, এ সব সমস্যা নিতান্তই সাময়িক। যে-সব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তাও সাময়িক। অর্থাৎ চিন্তার কোনও কারণ নেই। কিন্তু যে-সব মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার, শেয়ার বাজার, সোনা এবং বিদেশি মুদ্রার বাজারে বিচরণ করেন তাঁরা জানেন, চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে। সুরক্ষার পাঁচিল ভেঙে পড়ছে সর্বত্র। চিন্তার রেখা স্পষ্ট এখন সবার কপালে। আশার আলো একটাই। আষাঢ়-শ্রাবণে বর্ষণ হয়েছে পর্যাপ্ত। এতে জলের স্তর খানিকটা বাড়বে সন্দেহ নেই। কিন্তু জলাধার ভরবে না। জল ধরে রাখতে চাই ছিদ্রগুলির পাকাপাকি মেরামতি। সেটাই সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। একনজরে দেখে নেওয়া যাক ছিদ্রগুলির গতিপ্রকৃতি।
১) শিল্পোৎপাদন হ্রাস। সুদের হার না-কমায় বহু পণ্যের চাহিদা কমে আসা এর কারণ। গত অর্থবর্ষে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার নেমে এসে ঠেকেছিল ৫ শতাংশে। চলতি বছরে লক্ষ্য ৬.৫% হলেও শিল্পোৎপাদনের অবস্থা দেখে অনেকেরই আশঙ্কা, ৫% বৃদ্ধির হার ধরে রাখাই এ বার শক্ত হবে। এরই মধ্যে অনেকটা লগ্নি ফিরিয়ে নিয়েছে বেশ কিছু বিদেশি সংস্থা। আশঙ্কা, বিদেশি লগ্নির বহির্গমন আগামী দিনেও চলতে পারে। মার্কিন অর্থনীতিতে উন্নতির হাওয়া লাগায় এই আশঙ্কা জোরালো হচ্ছে। জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার ধরে রাখার জন্য কৃষিই এখন ভরসা।
২) টাকার অধঃপতন। ডলার-সহ প্রধান প্রধান বিদেশি মুদ্রার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিই এর কারণ। এটিই এখন দেশের প্রধান সমস্যা। এতে চড়চড়িয়ে বেড়ে উঠছে আমদানির বিল। অন্য দিকে কয়েক মাস ধরে হ্রাস পাওয়ার পর সম্প্রতি রফতানি বেড়েছে। ডলারের দাম এতটা বাড়ায় হয়তো কয়েক দিনের মধ্যে বাড়ানো হবে পেট্রোল-ডিজেলের দাম।
৩) অর্থ মন্ত্রক, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পদক্ষেপ। টাকার মূল্যপতন সামাল দিতে তড়িঘড়ি একগুচ্ছ ব্যবস্থা নিয়েছে অর্থ মন্ত্রক ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা থেকে শুষে নেওয়া হয়েছে মোটা টাকা। পরোক্ষ ভাবে বাড়ানো হয়েছে ঋণে সুদ। শিল্পের জন্য এটি আদৌ শুভ বার্তা নয়।
৪) মার্কিন অর্থনীতি। মার্কিন অর্থনীতি উন্নতির মুখ দেখায় সে দেশে আর্থিক ত্রাণ কমে আসতে পারে, এই আশঙ্কা প্রবল। এতে ভারতে ডলার-প্রবাহ কমে আসবে। ফলে আরও পড়তে পারে টাকার দাম।
৫) মূল্যবৃদ্ধি। দ্রুত বাড়ছে জিনিসের দাম। আগের কয়েক মাসে কমলেও জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধি বেড়ে পৌঁছেছে ৫.৭৯%-এ। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ১২% ছুঁইছুঁই। আদা-পেঁয়াজের নেতৃত্বে সাধারণ মানুষের চোখে জল এনেছে বহু নিত্য- প্রয়োজনীয় পণ্য। ডলার এবং জিনিসের দাম এতটা বাড়ায় সুদ কমার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ফলে হতাশ শেয়ার বাজার।
৬) লেনদেন ঘাটতি। বড় আকারে বিদেশি মুদ্রা বেরিয়ে যাওয়ায় চলতি খাতে লেনদেন ঘাটতি বেড়েই চলেছে। আশঙ্কা, এতে ভারতের ক্রেডিট রেটিং কমতে পারে। তা যদি হয়, তবে তা বড় আঘাত হানবে শেয়ার বাজারের উপর।
৭) কেন্দ্রে দুর্বল সরকার। আর্থিক সংস্কারের কাজ দৃঢ় হাতে করতে অসফল কেন্দ্র। টাকার পতন ঠেকাতে হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ নানা ক্ষেত্রে। আশঙ্কা, উদারনীতির জায়গায় নিয়ন্ত্রণ রাজ ফের কায়েম হতে পারে।
৮) সামনে ভোট। নতুন সরকার গঠিত না-হওয়া পর্যন্ত বড় আকারে লগ্নির পথে অনেকেই এগোবেন না। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কেন্দ্রে শক্তিশালী সরকার গঠিত হওয়াও বেশ শক্ত। দুর্নীতির চাপে জর্জরিত সরকার। এটাও নিরুৎসাহিত করছে বিদেশি লগ্নিকারীদের।
৯) নগদের জোগান। সুদ না-কমলে, টাকার জোগান না-বাড়লে পণ্য-চাহিদা বাড়বে না। কিন্তু টাকার মূল্যপতন রুখতে তার জোগান কমানো হচ্ছে। বাড়ছে সুদের হার। পরিস্থিতি শাঁখের করাতের মতো।
এতগুলি প্রতিকূল অবস্থা সামাল দেওয়া অত্যন্ত শক্ত। সমস্যাগুলি নিজেদের মধ্যে নিবিড় ভাবে সম্পর্কযুক্ত। একক সমাধান তাই সম্ভব নয়। বুকে ব্যথার ওষুধ দিলে পেটে ব্যথা শুরু হচ্ছে। দুর্বল হচ্ছে পায়ের পেশি। চিদম্বরম যা-ই বলুন, ছোট মেয়াদে এই সব সমস্যা সমাধান হওয়ার নয়। প্রশ্ন হল, এই কঠিন পরিস্থিতিতে লগ্নিকারীদের কী করণীয়। একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যাক:
• সূচক যা-ই বলুক, দু’তিনটি শিল্প বাদে বাকি সব শেয়ারই ভাল রকম পড়েছে। আরও পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। পড়লে অবশ্য ছোট করে ওঠার সম্ভাবনাও থাকবে। তবে বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কেনাবেচা করা হয়তো অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে এঁরা শেয়ার বাজার এড়িয়ে চললেই ভাল করবেন।
• বাজার যদি আরও নামে, তবে লার্জ ক্যাপ ভাল শেয়ার কিনুন। মাঝারি ও ছোট শেয়ারে বেশি ঝুঁকি থাকবে। এফএমসিজি, ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি, রফতানি প্রধান সংস্থার প্রতি নজর রাখুন। আমদানি নির্ভর সংস্থার শেয়ার এড়িয়ে চলুন। কৃষি নির্ভর সংস্থার শেয়ার ভাল হতে পারে।
• সুদের হার কমার জায়গায় বাড়তে শুরু করেছে। এতে ঋণপত্রের বাজারে পতন এসেছে। লগ্নির জন্য এই জায়গাটিও এখন আদর্শ নয়।
• ব্যাঙ্ক সুদ আবার ঊর্ধ্বমুখী। অর্থনীতি যত দিন ঠিক না-হয়, সাবধানী মানুষেরা তত দিন সঞ্চিত টাকা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রেখে নিশ্চিন্ত হতে পারেন। একটু বড় মেয়াদে ডাকঘরও মন্দ নয়।
• ইক্যুইটি এবং ঋণপত্রের বাজার, দু’জায়গাতেই দুর্দিন চলায় সময়টা ভাল নয় মিউচুয়াল ফান্ডের জন্য। পড়া বাজারে ডিভিডেন্ড ইল্ড ইউনিট কেনা যেতে পারে।
• সোনা আবার স্ব-মহিমায়। গোল্ড ইটিএফ-এ যাঁরা লগ্নি করেছিলেন, তাঁদের দুশ্চিন্তা কমেছে। ডলারের দাম বাড়তে থাকলে সোনার দরে পতন আশা করা হচ্ছে না। সোনায় আমদানি শুল্ক বাড়ায় চোরাচালান বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল। সামনে উৎসব। চাহিদা কমার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
• ৪৮,০০০ কোটি টাকা মূল্যের করমুক্ত বন্ড ইস্যুর অনুমতি দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সংস্থাকে। ডিসেম্বরের মধ্যেই বাজারে এসে যেতে পারে এই বন্ড। সরকারি ঋণপত্রের ইল্ড বেড়ে ওঠায় এই বন্ডে সুদ খারাপ হবে না। করদাতারা অপেক্ষা করতে পারেন এই বন্ডের জন্য।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.