তেলেভাজার দোকানের কাচের বাক্সে বড়-বড় হরফে কাগজ সাঁটা, ‘পেঁয়াজি নেই!’
বর্ষার সান্ধ্য মৌতাতের বারো আনাই ফাঁকি!
পেঁয়াজি যেখানে নেই, সেখানে হা-হুতাশ এক রকমের। আর যেখানে পেঁয়াজি মিলছে নাম-কা-ওয়াস্তে, সেখানে পেঁয়াজির আধারে চুপিচুপি চালান হচ্ছে মাত্রাছাড়া বেসন কিংবা ঢালাও বাঁধাকপি। শহরের ধ্রুপদী পেঁয়াজি-শিল্পীরাও বাধ্য হয়ে পেঁয়াজির সাইজ বা পরিমাণ এক ধাক্কায় অনেক দূর কমিয়ে ফেলেছেন।
বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে কয়েক পুরুষ ধরে পেঁয়াজি-শিল্পে হাত পাকানো রাজু সাউ বললেন, “বুঝলেন দাদা, তেলেভাজার ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর হল গিয়ে আলুর চপ-বেগুনি-পেঁয়াজি!” কিন্তু পেঁয়াজের আকাশছোঁয়া দামের জেরে এই
মুহূর্তে সেই ‘মহেশ্বর’ই রীতিমতো সংকটে! রাজুর আক্ষেপ, ‘‘সমঝদারের কাছে পেঁয়াজির আলাদা কদর! আজকালকার নতুন ভাজাভুজি তার ধারেকাছে নেই!”
সে-কালের উত্তর কলকাতায় শেষপাতে খেতে বসার সময় মহিলারা অনেকেই ভাতের সঙ্গে টাকনা হিসেবে পাড়ার দোকান থেকে পেঁয়াজি-ফুলুরি আনিয়ে নিতেন। তখন শ্যামবাজারের থিয়েটার-পাড়ার শিল্পীদের কাছেও তেলেভাজার মধ্যে পেঁয়াজিই ছিল সব থেকে আদরের। তেলেভাজা নিয়ে সে-দিনের ছড়া এখনও মুখে-মুখে ফেরে।
‘চপ খাব আস্ত
তৈরি করব স্বাস্থ্য
বেগুনি খাব গোটা
আমরা হব মোটা
পেঁয়াজি খাব শেষে
খাব ভালবেসে!’
ছড়াকার স্বয়ং জহর রায়! |
সাবেক কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে (অধুনা বিধান সরণি) যে রংমহলে জহর রায় অভিনয় করতেন, তার উল্টো ফুটের লক্ষ্মীনারায়ণের তেলেভাজা-বিশারদেরা অবশ্য এই দুর্বিপাকেও তাঁদের পেঁয়াজি নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন। কিন্তু দোকানের অন্যতম কর্তা মোহন গুপ্ত মানছেন, চাপে পড়ে রসিকজনকে বিমুখ করে পেঁয়াজি ভাজার পরিমাণ অর্ধেকের বেশি কমিয়ে দিতে হয়েছে। লক্ষ্মীনারায়ণে পেঁয়াজির দাম দিন কুড়ি আগেই বেড়ে চার টাকা থেকে পাঁচ টাকা হয়েছে। তাই গত কয়েক দিনে পেঁয়াজের চড়া দামেও এখনই আরও এক বার দাম বাড়ানোর রাস্তায় তাঁরা হাঁটতে পারছেন না। কিন্তু দোকানে পেঁয়াজের রোজকার রসদের পরিমাণ গত তিন দিনে এক ধাক্কায় কমে ১০০ কিলোগ্রাম থেকে ৫০-৬০ কিলোগ্রামে এসে ঠেকেছে। মোহনবাবু বলছিলেন, “পেঁয়াজির মানে আপস করতে পারছি না বলেই চাহিদা থাকলেও পেঁয়াজি ভাজা ইদানীং এতটা কমিয়ে দিয়েছি।”
বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে ফুটপাথের বিভিন্ন ঠেকে রাজু সাউ বা আশুতোষ সাউরাও চেষ্টা করছেন, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থা থেকেই ঘুরে দাঁড়াতে। প্রাক্-স্বাধীনতা দিবসের সন্ধেয় অফিস-ফেরত জনতাকে লোভ দেখিয়ে আশুতোষ জোর গলায় হাঁকছেন, “আসলি পেঁয়াজি দাদা, খাঁটি পেঁয়াজ! বাঁধাকপি নেই!” জিজ্ঞেস করাতে চুপিচুপি বললেন, পেঁয়াজির সাইজ কিন্তু ছোট করতে হচ্ছে। আগে এক কেজি পেঁয়াজে ৩০টা পেঁয়াজি হতো। এখন করতে হচ্ছে ৩৫-৪০টা।
শুধু পেঁয়াজি নয়, সঙ্কটের ছায়া সামগ্রিক ভাবে নাগরিক ভোজ-বিলাসের পটভূমিতেই। পেঁয়াজ বিহনে সান্ধ্য নোলার টানে কিছুমিছু চাখার আনন্দেও ফাঁক থেকে যাচ্ছে। চাঁদনি চকের এক রোলের দোকানে দেখা গেল, পেঁয়াজের বিরাট বাটিময় শুধুই শসার সমারোহ। পানশালার টাকনা হিসেবেও চাকা-চাকা পেঁয়াজে বিটনুন ছড়িয়ে দেওয়ার বদলে পরিচিত বেয়ারা এখন খদ্দেরকে সন্তর্পণে মুলো বা শাঁকালু সাজিয়ে দিচ্ছেন।
চাঁদনি চক এলাকারই একটি পুরনো পানশালার কর্ণধার তৃপ্তিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, “যা দিনকাল, স্যালাডে পেঁয়াজের ভাগটা কমাতেই হয়েছে।” বুধবার নিউমার্কেটে পেঁয়াজের পাইকারি দরই ছিল ৫৯ টাকা। ‘ভোজ’ কেটারারের কর্তা রানা চট্টোপাধ্যায়ও মানলেন, উৎসব-অনুষ্ঠানে ফিশ ফ্রাইয়ে পেঁয়াজের ভাগ কমছে। স্যালাডেও চাকা-চাকা কেটে দেওয়া পেঁয়াজের পরিবর্তে কুচোনো পেঁয়াজ দিয়েই সামাল দেওয়া হচ্ছে। তবে রানাবাবুদের স্বস্তি, ভাদ্র মাসটা পড়ে গেলে আর বিয়ের দিন নেই!
ভাগ্যিস! |