|
|
|
|
নেতা খুনের পিছনে অবৈধ কয়লা কারবারের ছায়া |
দয়াল সেনগুপ্ত • খয়রাশোল
নীলোৎপল রায়চৌধুরী • পাণ্ডবেশ্বর |
রাজনীতি না কি কয়লা পাচারের কারবার? না কি দুই-ই?
বীরভূমের খয়রাশোলে তৃণমূল নেতা অশোক ঘোষ খুনের পিছনে ঠিক কী, সেই প্রশ্নই বড় হয়ে উঠেছে। বিশেষত গ্রেফতার হওয়া চার জনের দু’জন যখন পাশের জেলা বর্ধমানের পাণ্ডবেশ্বর এলাকার। ঘটনার মূল চক্রী সন্দেহে পুলিশ যাকে আটক করেছে, তিনিও তা-ই। সকলের রাজনৈতিক পরিচয়ও এক নয়।
তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই এই খুন, এমন অভিযোগে ইতিমধ্যে বীরভূম উত্তাল হয়েছে। দলীয় কর্মীদের একাংশের বড়সড় বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। কিন্তু গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সঙ্গে কয়লা কারবারের বখরার গল্পও যে জড়িয়ে, তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
বুধবার রাত পর্যন্ত খয়রাশোলের যে দু’জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে, তাঁরা দু’জনেই তৃণমূলের লোক এবং গোষ্ঠী রাজনীতিতে অশোক ঘোষের বিরোধী, অনুব্রত-অনুগামী অশোক মুখোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। পাণ্ডবেশ্বরে ধৃত আলামত আনসারির কাকা স্থানীয় তৃণমূল নেতা। কিন্তু অন্য জন, অনুজ সিংহের মা এই পঞ্চায়েত নির্বাচনেই সিপিএমের হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু এঁদের সকলেরই কয়লা কারবারে যোগাযোগ থাকতে পারে বলে পুলিশের অনুমান।
দীর্ঘদিন ধরেই বর্ধমানের রানিগঞ্জ কয়লাঞ্চল ও লাগোয়া খয়রাশোলের রাজনীতির পিছনে কয়লা কারবারের বড় ভূমিকা রয়েছে। যখন সিপিএম ক্ষমতায় ছিল, তখন এই অবৈধ কয়লা কারবারের নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের হাতে। সরকার বদলের পরে তা তৃণমূলের হাতে চলে যায়। কিন্তু সিপিএমের জমানায় দলীয় অনুশাসনের ফলে যা সন্তর্পণে ছকে বাঁধা রাস্তায় চলত, তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সুবাদে তা-ই প্রকট হয়ে উঠেছে।
আগে বর্ধমান ও ঝাড়খণ্ড থেকে অজয় নদ পেরিয়ে পাচার হয়ে আসত কয়লা। পরে ওই ব্লকেরই কাঁকরতলায় গড়ে একটি বেসরকারি কয়লা সংস্থার খোলামুখ খনি গড়ে ওঠে। তাকে কেন্দ্র করে এলাকার কর্তৃত্ব, তোলা আদায় ও কয়লা কারবারের বখরার বিষয়টি রাজনীতির কেন্দ্রে চলে আসে। জেলা তৃণমূলের একাংশের দাবি, বখরার ভাগ পৌঁছয় জেলা ও রাজ্যস্তরের কিছু নেতার কাছেও। কে কত টাকা দিতে পারছে, তার উপরেই এলাকার নেতার কদর নির্ভর করে। দুই গোষ্ঠীর বিবাদের সূত্রপাতও সেই কারবারের বখরা নিয়েই। এক গোষ্ঠীর মাথায় ছিলেন প্রাক্তন ব্লক তৃণমূল সভাপতি অশোক ঘোষ। অন্য গোষ্ঠীর নেতৃত্বে বর্তমান ব্লক সভাপতি অশোক মুখোপাধ্যায়। দু’টি গোষ্ঠীই এলাকার দখল রাখতে মরিয়া। কেননা রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ না থাকলে কয়লা কারবারের রাশ হাতে রাখা যায় না। আবার কয়লার টাকা না রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বজায় রাখা সম্ভব নয়। দুই-ই চলে হাত ধরাধরি করে।
তৃণমূল সূত্রের খবর, ক্ষমতার এই চাবিকাঠিই সম্প্রতি অশোক ঘোষের হাতে চলে আসছিল। সদ্য পঞ্চায়েত ভোটে খয়রাশোল ব্লকের ১০টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ৮টিতে জয়ী হয়েছে তৃণমূল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জয়ী প্রার্থীরা অশোক ঘোষের অনুগামী। দু’টি গ্রাম পঞ্চায়েত ত্রিশঙ্কু থাকলেও অশোক ঘোষের জন্য একটি কার্যত দখলে চলে এসেছে তৃণমূলের। খয়রাশোল পঞ্চায়েত সমিতিতেও জয়ী প্রার্থীদের অধিকাংশই তাঁর অনুগামী।
খয়রাশোল ও পাণ্ডবেশ্বর আলাদা জেলায় হলেও দুই এলাকা আসলে একেবারে পাশাপাশি। খয়রাশোলের মানুষ নানা দরকারে দুবরাজপুর বা সিউড়ির চেয়ে বরং বর্ধমানের দিকে যেতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। দুই এলাকার রাজনীতি, কারবার, জনজীবনের ধরন-ধারণও একই রকম। বছর চারেক আগেও পাণ্ডবেশ্বরে অশোক ঘোষের গ্রিল গেটের দোকান ছিল। তিনি রাজনীতিতে বেশি জড়িয়ে পড়ায় তা উঠে যায়। কিন্তু এলাকায় বহু পুরনো যোগাযোগ থেকেই গিয়েছিল। পাণ্ডবেশ্বর থেকে ধরা পড়া দুই যুবকের পরিবারই অবশ্য দাবি করছে, তাঁদের ফাঁসানো হয়েছে। পুলিশের বক্তব্য, সোমবার খুনের আধ ঘণ্টা পরে খয়রাশোল থেকে পাণ্ডবেশ্বরে যাওয়ার সময়ে জনতা দুই যুবককে অস্ত্র-সহ ধরে। কিন্তু আলামতের কাকা, পাণ্ডবেশ্বরের তৃণমূল নেতা লোকমান আনসারি তা মানতে নারাজ। তাঁর সঙ্গে দলের পাণ্ডবেশ্বর ব্লক সভাপতি নরেন চক্রবর্তীর গোষ্ঠী-বিবাদ সর্বজনবিদিত। তাঁর দাবি, চায়ের দোকানে বসে চা খাওয়ার সময়ে নরেন গোষ্ঠীর লোকেরা আলামত ও অনুজকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
অনুব্রতবাবু অবশ্য কয়লার কথাই তুলেছেন। তাঁর দাবি, “ওই এলাকায় আমাদের একাধিক নেতা-কর্মী খুনে পাণ্ডবেশ্বরের কয়লা মাফিয়াদের জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে আসছে। এসপি-র সঙ্গে কথা বলেছি।” |
|
|
|
|
|