|
|
|
|
অনুব্রতর নাম নেই জড়িতদের তালিকায়, উধাও মূল অভিযুক্ত |
দয়াল সেনগুপ্ত • খয়রাশোল |
অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে তাঁরা প্রকাশ্যে মুখ খুলেছিলেন মঙ্গলবার। বলেছিলেন, তাঁর চক্রান্তে খুন হতে হয়েছে খয়রাশোলের তৃণমূল নেতা অশোক ঘোষকে। মঙ্গলবার রাতেই নিহতের স্ত্রী বিজয়া ঘোষ খয়রাশোল থানায় মোট ১২ জনের বিরুদ্ধে যে এফআইআর করেছেন, তাতে অবশ্য কোথাও নাম নেই বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতির! আর যাঁর বিরুদ্ধে এফআইআরে মূল অভিযোগ, খয়রাশোলের সেই ব্লক তৃণমূল সভাপতি অশোক মুখোপাধ্যায় গা ঢাকা দিয়েছেন।
ঘটনা হল, মঙ্গলবার নিহত নেতাকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং অনুব্রত দলেরই কর্মীদের তুমুল বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন। খয়রাশোলে গিয়েও বিক্ষোভকারীদের তাড়া খেয়ে গাড়িতে পালাতে হয় অনুব্রতকে। পার্থবাবুকেও দীর্ঘক্ষণ আটকে রেখে বিক্ষোভ হয়। পোড়ানো হয় ব্লক তৃণমূলের কার্যালয়। প্রকাশ্যেই তৃণমূল কর্মীরা খুনের ঘটনায় অনুব্রতর বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগ করেন। জেলা পুলিশেরই একটি সূত্রে অবশ্য জানা যাচ্ছে, প্রথমে লিখিত অভিযোগের এক নম্বরে নাম ছিল অনুব্রতরই। পরে সিদ্ধান্ত বদলে অনুব্রতর নাম বাদ দিয়ে এফআইআর করা হয়। কেন?
নাম বাদ দেওয়ার কথা মানতে চাননি নিহতের পরিবারের কেউই। অশোক ঘোষের স্ত্রী বিজয়াদেবী বলেন, “সিউড়ির বিধায়ক স্বপন ঘোষের (অনুব্রত-বিরোধী) মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে দোষীদের শাস্তি চাইব। ওঁর প্রতি আস্থা আছে।” |
|
নিহত ও পলাতক। অশোক ঘোষ ও (ডান দিকে) অশোক মুখোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র |
পরিবারের আর এক সদস্যের বক্তব্য, “অনুব্রতর নাম থাকলে তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে, তাই তাঁর নাম দেওয়া হয়নি।” নিহতের ছেলে বিশ্বজিৎ ঘোষের মন্তব্য, “এফআইআরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত বাড়ির বড়রা নিয়েছেন। তবে, তুচ্ছ এফআইআরে আমাদের বিশ্বাস নেই। অনুব্রত মণ্ডলের নাম রাখা হয়নি, কারণ, ওঁকে এমনিতে পুলিশ ধরবে না। আমরা সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গিয়ে সব জানাব। অনুব্রত জেলার সর্বোচ্চ নেতা। তাই ওঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সর্বোচ্চ স্তরেই হতে হবে।” যদিও অনুব্রত এ দিন বলেন, “অশোক ঘোষের ছেলে আমার সন্তানতুল্য। ওই পরিবারের পাশে আমরা রয়েছি।”
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় দাবি করেছেন, অশোকবাবুর খুনের সঙ্গে অনুব্রত মণ্ডলের সম্পর্ক নেই। তবে তৃণমূল সূত্রের খবর, দলীয় স্তরে নিহতের পরিবারের ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা হয়েছে। তৃণমূল নেত্রীরও এ ব্যাপারে ভূমিকা আছে। দলের প্রথম সারির এক নেতার কথায়, “দলনেত্রীর সঙ্গে ওঁদের পরিবারের যোগাযোগ হয়ে থাকতে পারে।” তৃণমূলেরই একটি সূত্রের ইঙ্গিত, অনুব্রতবাবুর নামে যাতে অভিযোগ দায়ের না হয়, তার জন্য দলীয় স্তরেই চেষ্টা চালানো হয়েছে। নিহতের পরিবার সূত্রেও জানা যাচ্ছে, তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে তাঁদের কথা হয়েছে। তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য খুনের অভিযোগের বিষয়ে হস্তক্ষেপের কথা অস্বীকার করেছেন। সোমবার বিকেলে খয়রাশোলের চূড়র গ্রামে আততায়ীদের গুলিতে খুন হন অশোক ঘোষ। সেই ঘটনার এফআইআরে প্রথম নামটিই অশোক মুখোপাধ্যায়ের। আপাতত তাঁর বাড়ি তালাবন্ধ। তাঁর ভাই রজত মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেও অভিযোগ হয়েছে। অন্য যে ১০ জনের নাম রয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগ এলাকার তৃণমূল কর্মী হিসাবেই পরিচিত।
বিধায়ক স্বপনবাবুর দাবি, “অশোক ঘোষের সঙ্গে ছিলেন মানুষ। আর অশোক মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছিল সিপিএম থেকে আসা কিছু দুষ্কৃতী আর কয়লা মাফিয়া। এটাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন অনুব্রত মণ্ডলই।”
পুলিশ ইতিমধ্যেই চার জনকে গ্রেফতার করেছে। ধৃত আলামত আনসারি ও অনুজ সিংহের বাড়ি খয়রাশোল লাগোয়া, বর্ধমানের পাণ্ডবেশ্বরে। বাকি দু’জনের মধ্যে কালীচরণ দাস হলেন খয়রাশোল পঞ্চায়েত সমিতির সদ্য নির্বাচিত তৃণমূল সদস্য। আর অনুদয় বাউরি বীরভূম জেলা পরিষদে তৃণমূল সমর্থিত নির্দল হিসাবে লড়ে হেরেছেন। কালীচরণ ও অনুদয়, এই দু’জনই অশোক মুখোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বলেই তৃণমূল সূত্রের খবর। ধৃতদের দুবরাজপুর আদালতে তোলা হলে বিচারক তাঁদের তিন দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন।
বীরভূমের বিদায়ী পুলিশ সুপার মুরলীধর শর্মা জানান, শেখ সেলিম নামে আরও এক যুবককে পাণ্ডবেশ্বর থেকে আটক করা হয়েছে। সে এই ঘটনার অন্যতম চক্রী। অবৈধ কয়লার কারবারি সেলিমের সঙ্গে অশোক মুখোপাধ্যায়ের যোগাযোগ ছিল বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। বীরভূম জেলার এক পুলিশ কর্তার দাবি, ধৃতদের জেরা করে জেনেছেন, সেলিমই আলামত, অনুজকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ভাড়া করেছিল অশোক ঘোষকে মারার জন্য। পুলিশের দাবি, খুনের ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই আগ্নেয়াস্ত্র-সহ পাণ্ডবেশ্বরে স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতে ধরা পরে অনুজ ও আলামত। এলাকাবাসীই তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেন। ওই পুলিশকর্তা বলেন, “আমরা জেনেছি, সেলিম, অনুজ ও আলামত ছাড়াও খুনের সময় সেখানে আরও দু’জন ছিল। অশোকবাবুকে গুলি করে আলামত। পাণ্ডবেশ্বর থেকে ওকে যখন আটক করার হয়, তখনও ওর হাতে ছিল গান পাউডারের গন্ধ।”
খয়রাশোলে নিহত নেতার অনুগামী কর্মীদের একাংশের দাবি, শেখ সেলিম এখানে বোড়ে মাত্র। কার বা কাদের নির্দেশে সে ‘সুপারি কিলার’ দিয়ে খুন করিয়েছে, সেটা জানা দরকার। নিহতের স্ত্রী বিজয়াদেবী ও মেয়ে সোমা রাখঢাক না করেই দাবি করেছেন, খুনের মূল চক্রান্তকারী অশোক মুখোপাধ্যায়। তাঁকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে না ধরা হলে আন্দোলনে নামার হুমকি দিয়েছেন বিশ্বজিৎ।
তৃণমূল সূত্রের খবর, খয়রাশোলে অশোক ঘোষের জনসমর্থন বেড়ে যাওয়ায় ক্রমশ অশোক মুখোপাধ্যায় পিছনের সারিতে চলে যাচ্ছিলেন। এই ব্লকে তৃণমূলের দখলে আসা সিংহভাগ পঞ্চায়েতে কে প্রধান, উপ-প্রধান প্রধান হবেন, তা নিয়েও প্রবল দ্বন্দ্ব বেধেছিল দুই অশোকের মধ্যে। পাল্লা ভারী ছিল অশোক ঘোষেরই। সোমবার বিকেলে সেই নেতাই খুন হওয়ার পরে তাই জনরোষ ছড়ায় গোটা এলাকায়। যা মঙ্গলবার প্রত্যক্ষ করেছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও অনুব্রত মণ্ডল। মঙ্গলবার রাতে ফের অশোক মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির সামনের তৃণমূল কার্যালয় ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রতিবেশীরা জানান, মঙ্গলবার সকাল থেকেই সপরিবার বাড়ি ছেড়েছেন ব্লক তৃণমূল সভাপতি।
যদিও অনুব্রত মণ্ডলের দাবি, “অশোক মুখোপাধ্যায় নির্দোষ। ব্লক সভাপতির সঙ্গে যে তাঁর ভাল সম্পর্ক ছিল, সে কথা অশোক ঘোষই আমাকে জানিয়েছিলেন।” |
পুরনো খবর: বিক্ষোভের মুখে পার্থকে ফেলেই চম্পট অনুব্রতর |
|
|
|
|
|