|
|
|
|
স্মৃতিতে ১৬ অগস্ট |
মাঠে হারানো বাবাকে স্মরণ ফুটবলেই
অভিষেক চট্টোপাধ্যায় |
মাঠ কেড়ে নিয়েছে প্রিয়জনকে। মাঠের মধ্যেই সেই প্রিয়জনকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁরা।
১৯৮০ সালের ১৬ অগস্ট ইডেন গার্ডেনসে মৃত্যু এক সুতোয় বেঁধেছিল কয়েকটি পরিবারকে। যেমন হাওড়ার দু’টি পরিবার। একই জেলায় বাস হলেও যারা কেউ কারও চেনা নয়। বহু দূরের সম্পর্ক ঘাঁটলেও কেউ কারও আত্মীয় নন। তবু একই ভাবে তারা স্বজনের স্মৃতি ধরে রেখেছে। দুই পরিবারই মৃতের স্মরণে এলাকায় চালু করেছে ফুটবল প্রতিযোগিতা। ‘পিতৃতর্পণে’র জন্য দুই বাড়িরই ছেলেরা বেছে নিয়েছেন ফুটবলকে। বেছে নিয়েছে ‘গো-ও-ও-ল’ চিৎকার। যে চিৎকার তাঁদের বাবার খুব প্রিয় ছিল।
১৯৮০ সালে সেই দিনে কলকাতা লিগে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল খেলার দ্বিতীয়ার্ধে খেলোয়াড়দের মধ্যে গোলমাল বাধে। মোহনবাগানের বিদেশ বসুর সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের দিলীপ পালিতের মধ্যে গণ্ডগোলের রেশ ছড়িয়ে পড়ে গ্যালারিতেও। প্রাণ হারান ষোলো জন। তাঁদেরই মধ্যে দু’জন ছিলেন হাওড়ার ডোমজুড়ের ধনঞ্জয় দাস ও জগৎবল্লভপুরের কার্তিকচন্দ্র মাঝি।
এর মধ্যে বদলে গিয়েছে অনেক কিছু। ইডেনে ফুটবল বন্ধ হয়েছে অনেক দিন। ফুটবল মাঠে সে দিনের মৃতদের স্মৃতি এখন শুধু ইডেনের সামনের শহিদ স্তম্ভে আর ১৬ অগস্ট ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ ভলেন্টিয়ার ব্লাড ডোর্নস’ এবং আইএফএ-র উদ্যোগে হওয়া রক্তদান শিবিরে। তবে বাবার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে ফুটবলকেই হাতিয়ার করেছেন ধনঞ্জয়বাবু ও কার্তিকবাবুর ছেলেরা।
প্রতি এক বছর অন্তর শীতকালে স্থানীয় প্রাচ্যভারতী স্টেডিয়ামে ধনঞ্জয়বাবুর নামে ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে স্থানীয় বিল্পবী সঙ্ঘ। এলাকার ক্লাব ছাড়াও খেলতে আসে কলকাতার অনেক নামী ক্লাব। প্রতি বছর ১৬ অগস্ট এলাকায় ধনঞ্জয়বাবুর স্মরণে আয়োজন করা হয় রক্তদান শিবিরের। কার্তিকবাবুর স্মৃতিতে এলাকায় দু’টি ফুটবল প্রতিযোগিতা হয়। ১৬ অগস্ট এলাকার স্কুলগুলিকে নিয়ে ও ২৬ জানুয়ারি স্থানীয় ক্লাবগুলি নিয়ে।
ধনঞ্জয়বাবু যখন মারা যান তাঁর বড় ছেলে স্বপনবাবুর বয়স তখন বছর কুড়ি। যে ফুটবল মাঠে বাবার প্রাণ গিয়েছে, স্মৃতিরক্ষায় সেই ফুটবলকেই বেছে নিলেন কেন? স্বপনবাবু বলেন, “মোহনবাগানের খেলা থাকলেই মাঠে যেতেন বাবা। এমনকী প্রিয় দলের খেলা দেখতে মুম্বই পর্যন্ত ছুটে যেতেন। বাবা মারা যাওয়ার পরে বেশ কিছু দিন ফুটবলের কোনও খবর রাখতাম না। কিন্তু বেশি দিন থাকতে পারিনি। ফুটবলকে তো আমরাও ভালবাসি।” এখন নিয়মিত ফুটবলের খবর রাখেন দাস পরিবারের দুই ছেলে স্বপনবাবু ও সুভাষবাবু। এখন তাঁরা মনে করেন, ১৬ অগস্ট ছিল নেহাতই একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু এমন যাতে আর না ঘটে, সে ব্যাপারে দর্শক ও ফুটবলার, দু’পক্ষকেই সচেতন থাকতে হবে। ধনঞ্জয়বাবুর স্ত্রী সাবিত্রীদেবীর বয়স এখন পঁচাশি ছুঁইছুঁই। স্মৃতি ধূসর হয়ে এলেও এখনও মনে সেই দুঃস্বপ্নের দিনের কথা মনে পড়ে। তাঁর শুধু প্রার্থনা, “খেলা দেখতে গিয়ে যেন আর কোনও মায়ের কোল খালি না হয়।”
কার্তিকবাবুও মোহনবাগানের সমর্থক ছিলেন। ১৯৮০ সালের ১৬ অগস্টের সময়ে তাঁর ছেলে রাজুর বয়স ছিল দু’বছর। বাবার কথা প্রায় কিছুই মনে নেই তাঁর। সেই সময় পরিবারকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিলেন কার্তিকবাবুর ভাইয়েরা। রাগ হয় না ফুটবলের উপর? রাজুবাবুর উত্তর, “ফুটবলকে বাবার মতো আমিও ভালবাসি। মাঠেও যাই। আমার মতে, বাবার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য ফুটবলই তো সবচেয়ে ভাল উপায়।”
অভিমানে ভুলে থেকে নয়, প্রিয়জনকে তাঁরা খুঁজে পান সেই ফুটবলেই।
|
|
|
|
|
|