প্রবন্ধ ২...
কেউ বউ পেটালে ভগবতীবাহিনী হাজির

সাতসকালে ল্যাঠা, ট্যাংরা জাতীয় কিছু মাছ নিয়ে ভগবতী ঘরের দরজায় হাজির। ভোররাত থেকে সারা মাঠ ঘুরে প্রচুর কালো মাছ পেয়েছে। কিছুটা বেচেছে, কিছুটা বাড়িতে রেখেছে আর বাকিটা আমাকে দিতে এসেছে। সর্বাঙ্গ জুড়ে একটা ছেঁড়া শাড়ি লেপ্টে আছে। আর চার-হাতি গামছা জড়িয়ে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা। ওর বয়েস ১৮-১৯ হবে। জন্মাবধি দারিদ্রের নানা কিসিমের আঘাত ওকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি দিতে পারেনি। গায়ে এক ছটাক মেদ নেই। হলহলে সাপের মতো চোখমুখ, কিছুটা ছুঁচলো। আর ছল-বল করা আজন্ম অভ্যাস। আমার কম্বাইন্ড হ্যান্ড জয়ন্তকে ডেকে বললাম, ‘মাছগুলো তুলে রাখো আর আমার পকেট থেকে পাঁচটা টাকা বের করে আনো।’
টাকার কথা শুনে ভগবতী বেদনাহত উচ্চৈঃস্বরে বলল, ‘আমার মাছ ফেরত দাও। তোমার দোরে আমি মাছ বেচতে আসিনি।’
‘এমনি কী করে নেব?’
‘ভালবেসে নেবে।’
এর কোনও উত্তর হয় না। ওকে দাওয়ায় বসতে বললাম এবং ছেলেমেয়েদের মা’কে ডেকে বললাম, ভগবতীকে তোমার একটা শাড়ি দিয়ে দাও। পুরনো কিছু দিলে বোধ হয় ভিখিরিকে দিচ্ছি, তাই একটা নতুন শাড়ি দিয়ে বললাম, ‘ভেতরে ঢুকে কাপড়টা ছেড়ে নে। না হলে নিমুনিয়া হয়ে মারা পড়বি।’
কোনও ওজর-আপত্তি না করে সে সোজা ঘরে ঢুকে গেল এবং নববস্ত্রে সজ্জিতা হয়ে বেরিয়ে এসে বলল, ‘যাই, আর এক বার মাঠটা চষে আসি। কালো মাছে মাঠ ভরে গেছে।’ আমার স্ত্রী চিৎকার করে বললে, ‘দুপুরে এখানে খাবি।’ ভগবতী জবাব দিল, ‘দুপুরে খেয়েদেয়ে তোমার ঘরের চালাটা ঝেড়েঝুড়ে সাপখোপ তাড়িয়ে রাত্রিতেও খেয়ে যাব।’ কয়েক দিন আগে আমার জ্যেষ্ঠা কন্যা মশারির দড়ি খুলতে গিয়ে দেখল, সাপের লেজ ধরে টানছে।
ভগবতী শশধরের জ্যেষ্ঠা কন্যা। এমনি সাত কন্যার জন্মের পর সোনার আংটি বাঁকাচরণের জন্ম। এক বার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘হাড়হাভাতের ঘরে সাতটি কন্যার জন্ম, একটু ভেবে দেখলে না? এদের মুখে অন্ন কোথা থেকে তুলবে?’ উত্তর পেয়েছিলাম, ‘যে বউ ছেলে বিয়োয় না, সে বাঁজা। মেয়েরা তো আর মুখে আগুন দিতে পারবে না। তার পরে একটা ছেলে না হলে সংসার শ্মশান। তবে আমি দু’এক বার আপত্তি করেছিলাম। বউয়ের পীড়াপীড়িতে এত সব কাণ্ড।’
খেটে খাওয়া, খেতে না পাওয়া দুর্বল শরীরে স্বপ্নের ধনের জন্ম দিতে গিয়ে এক বাঁকাচোরা বাঁকাচরণকে ধরিত্রীর বুকে দিয়ে জননী বিদায় নিয়েছে। তার পর দশ বছর বয়স থেকে ভগবতীকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল। জ্ঞান হওয়া থেকেই দেখেছে, বাবা গ্যাসট্রিকের রোগী। মাঝে মাঝেই অসহ্য পেটব্যথায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। চিকিৎসা গাঁয়ের সর্বরোগহরণ ধন্বন্তরী বামাচরণের দু’ফোঁটা করে তিন বার শিশির ওষুধ। তাতে রোগ বাড়ে বই কমে না। সেই দশ বছর বয়স থেকেই আমি ভগবতীকে দেখে যাচ্ছি। বাড়িতে এক গুচ্ছের ভাইবোনের দেখাশোনা, জ্বালানি কুড়িয়ে আনা, পরের বাড়ি ধান ভেনে দিন কাটানো, তার পর প্রায় সারা রাত পুরনো খবরের কাগজের ঠোঙা বানানো। ভোররাতে যা একটু ঘুম। কিন্তু কোনও দিন মুখে হাসি ছাড়া কখনও ওকে দেখিনি। অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারিণী, তা না দেখলে, না জানলে বোঝা যায় না।
আমার বাড়িতে তার অবারিত দ্বার। কিন্তু কখনও কিছু চেয়েছে বলে মনে পড়ে না। যতটুকু যা দিতে পারি, জোর করেই দিতে হত। আমাকে প্রায়ই বলত, ‘ভিক্ষে চাওয়াটা আমার আসে না। ওটা চাইবার আগে মরে যেতে ইচ্ছা হয়।’ মায়ার বাঁধনে আমার পরিবারকে বেঁধে ফেলেছিল। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করত ওর সব দায় ঘাড়ে নিয়ে নিই। ও মুক্ত প্রাণ নিয়ে ঝরনার মতো চার দিকে হাসি ছড়িয়ে যাক।
ভগবতীর বয়স বাড়ছে। এত পরিশ্রম, তবু, খুদকুড়ো সম্বল করেও, এক ধরনের সৌন্দর্য তার দেহে প্রকাশমান। এই উঠতি বয়সে গাঁয়ে-গঞ্জে মেয়েদের বিপদের শেষ নেই। ১৫ থেকে ৭৫, সব বয়সের পুরুষেরই দৃষ্টিতে এক ধরনের কামনার ছাপ থাকে। ভগবতীকে দেখেছি, সহজাত শক্তিতে সে সব কিছু এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। এক দিন, রাত তখন দশটা বাজে। ভগবতী আর তার পরের দু’বোন পাড়ারই এক ছোকরাকে ঝাঁটাপেটা করতে করতে দরজায় হাজির। ভগবতী আমার পায়ের তলায় তাকে শুইয়ে দিয়ে বলল, ‘মাস্টারবাবার কাছে বল, আর কোনও দিন এই কাজ করবি না।’ ভগবতীর হাতে সে দিন একটা দা ছিল। ছেলেটির ভাগ্য ভাল যে সেটা তার গলায় গিয়ে বসেনি। বোনেরাও ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। তারাও নানা ধরনের কাজকর্ম শিখে নিয়ে সংসারের হাল একটু ফেরাল। অন্তত দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন জোটার ব্যবস্থা হল। ভগবতী এক এক করে বোনেদের বিয়ে দিতে শুরু করল।
দ্বীপদ্বীপান্তর ঘুরে নিজের মনমত একটি ছেলে ধরে নিয়ে আসত এবং কোনও একটি বোনের সঙ্গে তার বিয়ে দিত। কোনও উৎসব নেই, আচার নেই, শুধু আমার বাড়িতে ছেলেটিকে এবং মেয়েটিকে বসিয়ে কোনও মন্ত্র উচ্চারণ না করে বিয়ের কাজ সারা হত। এমনি ছ’খানা শাড়ি, ধুতি এবং একরত্তি সোনা এটা বাড়িতে সব সময়ই জমা থাকত। ধীরে ধীরে বাড়ির সব বোনের বিয়ে হয়ে গেল। পড়ে রইল ভগবতী এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ছোট ভাই। ছোট ভাইকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসত। যেখানে যেটুকু ভাল কিছু জোগাড় করতে পারত, সেটা তার ছোট ভাইয়ের প্রাপ্য।
এর পরে ভগবতীকে সম্পূর্ণ অন্য ভাবে দেখলাম। গ্রামে একটি মহিলা সমিতি, সেখানে মহিলাদের জড়ো করে তাদের নিয়ে কিছু করা যায় কি না, এ ভাবনা তাকে পেয়ে বসল। ধীরে ধীরে সমিতির দূরে-কাছের গ্রামগুলিতে অনেক শাখা গড়ে উঠল। নানা দিক দিয়ে সহায় আসতে শুরু করল। মেয়েরা সংঘবদ্ধ ভাবে নানা ধরনের জিনিস উৎপাদন করতে শুরু করল এবং বিক্রির বাজারও ভালই পেল। আস্তে আস্তে চাষ, হাঁসমুরগি পালন, বাড়ির পুকুরের মাছ চাষ এ সব করে মেয়েরা সংগতি কিছুটা বাড়াতে পারল। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে দেখা দিতে থাকল আত্মপ্রত্যয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শক্তি এবং এমনকী অত্যাচারীর বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাতেরও শক্তি। মনে পড়ে এক রাত্রিতে গাঁয়ে ডাকাত পড়েছিল। ভগবতী বাকি সব মেয়েদের নিয়ে শুধু চিৎকার করে ডাকাতদের ঘরছাড়া করেছিল। বউ পেটানো গাঁয়ের পুরুষদের চিরন্তন অভ্যাস। কেউ বউ পেটালে ভগবতীর নেতৃত্বে দল বেঁধে মেয়েরা তার দরজায় হাজির হত। এখন এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, দূরদূরান্তের মেয়েদের ওপর কোনও অত্যাচার হলেও তারা সোজা ভগবতীদের সমিতির কাছে নালিশ জানাতে আসে। একটি ক্ষেত্রে জানি, ভগবতীবাহিনী যখন সে গ্রামে হাজির হয়, পুরুষ পুংগব গাছের আগায় উঠে বসে ছিল।
এই ভগবতী আমার কাছে আদর্শ নারী। আমি পিতার মতো তাকে ভালবাসি, সন্তানের মতো স্নেহ করি। কামনা করি যে, হাজার হাজার ভগবতীতে দেশটা ছেয়ে যাক। এরা মচকায় কিন্তু ভাঙে না। শত বিষাদেও কারও কাছে মাথা নোয়ায় না।
এর পরেও মা ভগবতীর বিবাহকার্য এক দিন সমাধা হল। দীর্ঘ কালের অমানবিক শ্রমজনিত কারণে শীর্ণ দু’টি হাতের মিলন ঘটল একটি গাবদাগোবদা দোজবরের মোটাসোটা হাতের সঙ্গে। শুনতে পাই ভগবতী বেশ সুখে আছে। হঠাৎ এক দিন জানালার ধারের রাস্তায় কোলাহলের শব্দ শুনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে দেখলাম যে, ভগবতী এবং তার স্বামীর বাগ্যুদ্ধ। জামাইকে নিয়ে বাপের বাড়ি এসেছে। দু’দিন পরে জামাতা বাবাজীবনের থাকতে লজ্জা। তাই বাড়ি চলে যেতে চায়।
ভগবতীর বিধাতাদত্ত সাবলীল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা, ‘তুমি দু’দিন শ্বশুরঘর করে পালাতে চাইছ, আর আমি যে বছরের পর বছর প্রাণপাত করে শ্বশুরঘরকে ভাল সংসার তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছি, সেটা কোনও কথা নয়? আরও দশ দিন শ্বশুরঘর করে তবে তুমি ছাড় পাবে।’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.