প্রবন্ধ ১...
এ পথে গোর্খাল্যান্ড সমস্যা মিটবে না
মুখ্যমন্ত্রীর ছবিসহ বহুবিজ্ঞাপিত ‘পাহাড় হাসছে’ হোর্ডিংকে ব্যঙ্গ করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে পাহাড়ে আগুন জ্বলছে। এই সমস্যার মোকাবিলায় আট দিন পাহাড় বনধের পর মুখ্যমন্ত্রী বনধ প্রত্যাহারের জন্য ৭২ ঘণ্টার চরমপত্র দিয়ে ঘোষণা করেছেন যে, ‘এনাফ ইস এনাফ, অনেক সহ্য করেছি, আমি রাফ অ্যান্ড টাফ’ ইত্যাদি ইত্যাদি, এবং কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। ইতিমধ্যেই পাঁচ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী পাহাড়ে মোতায়েন হয়েছে, পুরনো মামলায় ধরপাকড় শুরু হওয়ার পর জি টি এ-র কয়েক জন কাউন্সিল সদস্য-সহ গ্রেফতার হয়েছেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার দুই শতাধিক কর্মী-সমর্থক।
এই কড়া অবস্থানের সপক্ষে মুখ্যমন্ত্রী আদালতের বনধ-বিরোধী রায়কে তুলে ধরেছেন। তাঁর এই সাম্প্রতিক আদালত-প্রীতি সত্যিই চমকপ্রদ। এই সে দিন দুর্গাপুর হাইওয়ে বন্ধ করে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, গণ-আন্দোলন কখনও আদালতের নির্দেশ মেনে চলে না। অতি সম্প্রতি পঞ্চায়েত নির্বাচনে আদালতের রায় উপেক্ষা করেই তাঁর দলের বাইকবাহিনী রাজ্য জুড়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে! স্পষ্টতই, আদালতের রায় দেখিয়ে মুখ্যমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় চাবুক হাঁকিয়ে গোর্খা সমস্যার সমাধান করতে চাইছেন।
কিন্তু এই পথে পাহাড়ের সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ঘটনা হল, মুখ্যমন্ত্রী যতই ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ হবেন, ততই পাহাড়ে আরও বেশি রক্ত ঝরার সম্ভাবনা বাড়বে, সমতলবাসীর সঙ্গে পাহাড়ের মানুষজনের সম্পর্ক ততই তিক্ত হবে। বোঝার কথা হল, পাহাড়ের সমস্যা নিছক আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন নয়, ‘আপনজন’ চলচ্চিত্রের রবির গ্যাং-এর সঙ্গে ছেনো গুন্ডার লড়াই নয়। রাজনৈতিক সমস্যা দাবি করে রাজনৈতিক সমাধান, রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিলেও সেখানে সমাধান মেলে না।
গোর্খাল্যান্ডের দাবি আকাশ থেকে পড়েনি। এই দাবি সারা ভারতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তিন কোটি গোর্খা মানুষজনের আত্মপরিচয়ের জন্য উদগ্র আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। সে দিক দিয়ে গোর্খাদের দাবি তেলঙ্গানার থেকেও অনেক বেশি ন্যায়সঙ্গত। কারণ, ঐতিহাসিক ভাবে উদ্ভূত স্থায়ী জনগোষ্ঠী, যাদের অভিন্ন ভাষা, অভিন্ন বাসভূমি, অভিন্ন অর্থনৈতিক জীবন ও অভিন্ন মানসিক গঠন রয়েছে, তারাই স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে চিহ্নিত। এই হিসেবেই গোর্খারা এক স্বতন্ত্র জাতি। সেই কারণেই তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্থাৎ নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই নির্ধারণ করার অধিকার রয়েছে। ঘটনা হল, দার্জিলিং, কার্সিয়ং ও কালিম্পং— এই তিন মহকুমার জনসংখ্যায় গোর্খাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। তাঁরা যদি আত্মপরিচয়ের জন্য আলাদা রাজ্য দাবি করেন, তাতে আকাশ ভেঙে পড়ার কথা নয়। সাম্প্রতিক অতীতে দেশে তিনটি রাজ্য ভেঙে ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ়, উত্তরাখণ্ড হয়েছে, তাতে তো এত শোরগোল, রক্তপাতের প্রয়োজন হয়নি!
সেই ট্র্যাডিশন? সুবাস ঘিসিং (বাঁ দিকে) ও বিমল গুরুঙ্গ।
কিন্তু এত ছোট অঞ্চল নিয়ে কি আলাদা রাজ্য সম্ভব? সম্ভব নয় কেন? সিকিম বা গোয়া হাতের কাছেই আছে। আর, রাজ্য কেন, এর থেকে ছোট রাষ্ট্রই দুনিয়ায় রয়েছে। ১৯২৯ সালে গঠিত ভ্যাটিকান সিটি আজও বহাল তবিয়তে বিরাজমান। যার আয়তন ১১০০ একর, জনসংখ্যা ৮৩০। আছে সিঙ্গাপুর বা মোনাকো। আছে আরও নানা ছোট ছোট সার্বভৌম দেশ। আসলে আয়তনটা বড় কথা নয়, সবটাই রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রশ্ন।
সদিচ্ছার অভাবেই ঘোষণা করা হচ্ছে যে, আর বঙ্গভঙ্গ বরদাস্ত করা হবে না, দার্জিলিং আমাদের ভালবাসার জায়গা, অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ঘোষণা দেশভাগের যন্ত্রণাবিদ্ধ বাঙালি মননে উগ্র বাঙালিয়ানাকে উসকে দিতে বাধ্য। অথচ ইতিহাস বলে যে, দার্জিলিং অতীতে কোনও সময়েই আমাদের অংশ ছিল না। ১৯০৫ সাল পর্যন্ত দার্জিলিং ছিল ভাগলপুর মহকুমায়। ১৯১১ সালে কলকাতা থেকে দেশের রাজধানী স্থানান্তরের পরে ১৯১২ সালে দার্জিলিংকে বাংলায় যুক্ত করা হয়। তার আগে থেকেই পাহাড়ে স্বতন্ত্র রাজ্যের দাবি উঠেছে।
এই রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেই সি পি আই এম এত ছোট রাজ্য গঠনের বিরোধিতা করছে। তা হলে ক্ষুদ্র অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কি গ্রাহ্য নয়? অথচ কমিউনিস্টরা এতাবৎ নতুন-পুরনো, বৃহৎ ও ক্ষুদ্র সফল জাতির সমানাধিকারের কথা বলে এসেছে। আক্ষেপ এই যে, সি পি আই এম জাতি-প্রশ্ন নয়, অঞ্চলের আয়তনকেই নির্ধারক ভাবছে! অথচ ১৯৪৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টিই গোর্খালিস্থান-এর দাবি তুলেছিল।
তিনটি কথা এখানে বলা আবশ্যক।
, গোর্খাল্যান্ডের দাবি কোনও হঠাৎ গজিয়ে ওঠা উটকো দাবি নয়। ঘটনা হল, দার্জিলিঙের বাংলাভুক্তির আগেই ১৯০৭ সালে দার্জিলিঙের জন্য পৃথক প্রশাসনিক ব্যবস্থার দাবি করে ‘মর্লে-মিন্টো রিফর্মস’-এর কাছে প্রথম দাবিপত্র পেশ করে। ১৯১৭ সালে এই এলাকা থেকে এক প্রতিনিধিদল মন্টেগু-চেম্সফোর্ডের কাছে বাংলা থেকে আলাদা এক প্রশাসনিক ইউনিট দাবি করে।
১৯২৯ সালে সাইমন কমিশনের কাছে একই দাবি পেশ করা হয়। ১৯৩৪ সালে সেক্রেটারি অব স্টেটের কাছে হিলমেন অ্যাসোসিয়েশন অবিলম্বে দার্জিলিং জেলাকে বাংলা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন প্রশাসনিক ব্যবস্থার দাবি জানায়।
, গোর্খাল্যান্ডের দাবি এখন শুধু গোর্খাদের নয়, তা সমগ্র পাহাড়বাসীর দাবি। লক্ষণীয়, যে মঙ্গল সিংহ রাওয়াত সম্প্রতি এই আন্দোলনে আত্মাহুতি দিলেন, তিনি গোর্খা নন। সংবাদমাধ্যমে যাঁরা এখন গোর্খাল্যান্ডের পক্ষে কথা বলছেন, তাঁদের অনেকেই অ-গোর্খা। পাহাড়বাসী মুসলিমরা এই আন্দোলনের সমর্থনে অনাড়ম্বর ঈদ পালন করেন।
, রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিলেও গোর্খাল্যান্ডের দাবি নস্যাৎ করা যাবে না। লক্ষণীয়, এই দাবি পরিত্যাগের পর প্রবল পরাক্রান্ত সুবাস ঘিসিং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছেন, কিন্তু গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে। আজ যদি বিমল গুরুঙ্গ এই দাবি ছেড়ে দেন, কালক্রমে তিনিও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবেন, কিন্তু নতুন নেতা ধরে এই আন্দোলন আবারও প্রাসঙ্গিক হবে। আর যদি রক্তের বন্যায় এই আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করা হয়, তা হলে, নির্দ্বিধায় বলা যায়, ফিনিক্স পাখির মতো এই আন্দোলন আবার মাথা তুলবে। এটাই ইতিহাসের লিখন।
এত কথা বলার পর এটাও কিন্তু বলতেই হয় যে, গোর্খাল্যান্ড গোর্খা জনগণের মৌলিক সমস্যার সমাধান করবে না, বরং বিমল গুরুঙ্গদের দুর্বলতা ও দেউলিয়াপনাকেই উন্মোচিত করবে। ঘটনা হল, ঝাড়খণ্ডে শিবু সোরেন একদা যে বীরপূজা পেতেন, তাঁর সেই ঐশ্বরিক মহিমা আজ লুপ্তপ্রায়। তাই বলা যায় যে, গোর্খাল্যান্ড কোনও সমাধান নয়। দার্জিলিঙের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে থাকা বা না থাকার বিষয়টি এই পরিপ্রেক্ষিতে আলোচিত হওয়া উচিত। ভজিয়ে-ভাজিয়ে কোনও রকমে দার্জিলিংকে রাজ্যভুক্ত রাখার প্রয়াস বাদ দিয়ে, গোর্খা জনসাধারণকে উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে তাঁদের আস্থা অর্জন করেই পাহাড়ের সঙ্গে সমতলের সুসম্পর্ক রচিত হতে পারে। মমতাদেবী যে-পথে হাঁটছেন, তাতে পাহাড়বাসীর সঙ্গে সমতলবাসীর এক দীর্ঘস্থায়ী বিচ্ছেদ এড়ানো যাবে না।
আসলে পাহাড় সমস্যা নিয়ে উপলব্ধির খামতির জন্য মমতাদেবী আগাগোড়াই ভুল করে এসেছেন। তাঁর প্রথম ভুল হল, জি টি এ চুক্তিতে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা যেখানে গোর্খা রাজ্যের দাবি না ছেড়েই চুক্তি করছে, সেখানে নিজের অবস্থান স্পষ্ট ভাবে না-বলা। তাঁর দ্বিতীয় ভুল হল, জি টি এ গঠনের পর কার্যকর ক্ষমতা হস্তান্তর না করে জি টি এ’কে কাঠপুতলি বানিয়ে রাখা। তাঁর তৃতীয় ভুল হল, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার বিক্ষোভ নিরসনে যখন আলোচনা অপরিহার্য ছিল, তখন স্বকীয় ভঙ্গিতেই ধমকানো-চমকানোর পথ নেওয়া। তাঁর চতুর্থ ভুল হল, পদত্যাগের পর বিমল গুরুঙ্গ ও গোর্খা নেতৃত্বকে ডেকে আলোচনায় না বসে, কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনা না করে এবং সর্বদলীয় বৈঠক না করে ভীতি প্রদর্শনের পথ নেওয়া। এর ফল হিসেবেই পাহাড়ে সংঘাত অনিবার্য হয়েছে, অনিবার্য হয়েছে পাহাড়ের রক্তস্নাত ভবিষ্যৎ।
এই পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারে না। পাহাড়ের পরিস্থিতি এখন কেন্দ্রীয় উদ্যোগ দাবি করছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.