পুলিশ ঘুষ খায়, এই কথাটি এতই গা-সহা হইয়া গিয়াছে যে আর অস্বাভাবিক ঠেকে না। বরং, যদি প্রকাশ পায় যে ত্রিশ জন পুলিশ সার্জেন্টকে ঘুষ খাওয়ার অপরাধে লালবাজারে ডাকিয়া তিরস্কার করা হইয়াছে, তাহাতেই অবাক হইতে হয়। ঘটনাটি, অতি বিরল হইলেও, সম্প্রতি ঘটিল। রাস্তার বে-আইনি পার্কিং হইতে নিয়মিত ঘুষ আদায় করিতেন এই সার্জেন্টরা। অনুমান করা চলে, এই ত্রিশ জনই নহে, পুলিশ বিভাগের আরও অনেকেই বিবিধ পথে ঘুষ আদায় করিয়া থাকেন— এই ত্রিশ জনের কপাল পুড়িয়াছে, এই মাত্র। তিরস্কারই যথেষ্ট শাস্তি কি না, তাহাতে ঘুষ খাইবার প্রবণতার কিছুমাত্র ইতরবিশেষ হইবে কি না, এই প্রশ্নগুলি থাকিবেই। কিন্তু তবুও কিছু শাস্তি হইয়াছে, তাহাই ভরসা। আরও অনেক অপরাধ যেমন ‘অপরাধ’ হিসাবে বিবেচিতই হয় না। যেমন, কলিকাতার অতি ব্যস্ত একটি অঞ্চলকে পুলিশই ‘নো পার্কিং জোন’ ঘোষণা করিয়াছিল— এখন সেখানেই পুলিশের গাড়ি সার দিয়া দাঁড় করাইয়া রাখা হয়। যেমন, ট্রাফিক সিগনালে আর সব গাড়ি যখন দাঁড়াইয়া থাকে, পুলিশের গাড়ি তখন নির্দ্বিধায় আইন ভাঙে অথবা ওয়ান ওয়ে রাস্তার বিপরীত অভিমুখে গাড়ি হাঁকাইয়া দেয়— নিতান্ত অপ্রয়োজনেই। পুলিশের ছাপ থাকিলেই আইনের ঊর্ধ্বে অবস্থান করিবার হক জন্মে— এই মানসিকতাটিকে কর্তারা ‘অপরাধ’ হিসাবে বিবেচনা করেন কি? অভিজ্ঞতা বলিবে, না। অতএব, মোটরসাইকেল চালাইবার
সময় হেলমেট পরিবার আইনি বাধ্যতা ঘোষণা করা কলিকাতা পুলিশের বিজ্ঞাপনের সামনেই বিনা হেলমেটে বাইক চালাইবেন পুলিশকর্মী, নো পার্কিং-এ পুলিশের গাড়ি থাকিবে। আইন মানিলে আর দাপট কী?
দুইটি দুই গোত্রের অপরাধ, সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহাদের উৎস অভিন্ন— পুলিশ হওয়ার সুবাদে নিজেদের এক বিশেষ গোষ্ঠীর অংশ হিসাবে ভাবা। বহু পুলিশকর্মীর আচরণ দেখিলে প্রত্যয় হয়, ঘুষ যে তাঁহাদের অধিকার, সে বিষয়ে তাঁহাদের কোনও সংশয় নাই। পাসপোর্ট পাইবার জন্য সাধারণ মানুষের একটি পুলিশি ছাড়পত্র প্রয়োজন হয়। সেই ছাড়পত্রের প্রক্রিয়াটি ঘুষ ছাড়াই সম্পন্ন হইয়াছে, এমন দাবি খুব বেশি মানুষ করিতে পারিবেন না। ইহা উদাহরণমাত্র। যে পুলিশকর্মীরা তাঁহাদের কর্তব্য সম্পাদনের জন্য অথবা কর্তব্যে ফাঁকি দেওয়ার জন্য ঘুষ দাবি করিয়া থাকেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই তাহা করেন নিতান্ত অধিকারবোধে। তাঁহাদের একটি বাঁধা বুলিও আছে— ‘আমরা পাইয়া থাকি’। আবার, সাধারণ মানুষের জন্য যে আইন প্রযোজ্য, তাহাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইবার ক্ষেত্রেও সম্ভবত একই অধিকারবোধ কাজ করে— ‘আমরা আইন ভাঙিলে দোষ নাই’। লালবাজারের কর্তারা এই কথাগুলি জানেন না, তাহা বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু পুলিশকে আইনের প্রতি দায়বদ্ধ হওয়া শেখানো অপেক্ষা তাঁহাদের জরুরিতর কাজ আছে নিশ্চয়।
অবশ্য যে সমাজে ক্ষমতাবান মাত্রেই আইনের ঊর্ধ্বে থাকিবার অধিকারী, সেই সমাজে নীতির সহজ পাঠ পড়ানো অর্থহীন। রাজনৈতিক প্রভুরা যত আইন ভাঙেন, তাহার বড় অংশ পুলিশের মাধ্যমেই হয়। সেই প্রভুদের অনুচরবাহিনী, তস্য অনুচরবাহিনীও আইন বেঁকাইবার কাজে পুলিশকে ব্যবহার করিতে অভ্যস্ত। এই সর্বজনীন আইনহীনতার আবহে পুলিশ ব্যতিক্রম হইবে, এমন আশা বাড়াবাড়িই বটে। তবু কর্তারা চেষ্টা করিয়া দেখুন, যদি কিছু কাজ হয়। |