সেঞ্চুরির পথে এগোচ্ছে পেঁয়াজ।
দেশের বেশ কিছু শহরে ইতিমধ্যেই ৮০ টাকা কিলো দরে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। যা পরিস্থিতি তাতে পেঁয়াজের দাম খুব শীঘ্রই ১০০ টাকায় গিয়ে পৌঁছবে বলে মনে করা হচ্ছে। পেঁয়াজের মূল্যের এই ঝাঁঝ আক্ষরিক অর্থেই দেশের আমজনতার চোখে জল আনছে। স্বভাবতই দেশের অর্থনীতি থেকে কূটনীতি নিয়ে চিন্তায় থাকা মনমোহন সিংহ এবং পি চিদম্বরমের কপালে তাই নতুন দুশ্চিন্তার ভাঁজ। একেই মূল্যবৃদ্ধি লাগামছাড়া। তার পর লোকসভা ভোটের বছরে গৃহস্থের রান্নাঘরে আগুন লাগলে তার হল্কা যে ভোটবাক্সে গিয়েও লাগবে, তা ভালই জানেন কংগ্রেস নেতৃত্ব।
এ বিষয়ে শরদ পওয়ারের নেতৃত্বাধীন কৃষি মন্ত্রকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে কংগ্রেসের অন্দরমহলে। ফাটকাবাজি রুখতে, পেঁয়াজের জোগান বাড়াতে পওয়ার কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দেশের বাজারে টান পড়লেও ইন্দোনেশিয়া, মায়ানমার, সিঙ্গাপুর বা বাংলাদেশের মতো দেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করতে রাজি নন কৃষিমন্ত্রী। কারণ তাতে মহারাষ্ট্রের চাষিদের ক্ষতি। নিজের ভোটব্যাঙ্ক অটুট রাখতে পওয়ার তাঁদের লাভের কড়ি কেড়ে নিতে রাজি নন। তাই পাকিস্তান ও চিন থেকে কম দামে পেঁয়াজ নিয়ে এসে সেঞ্চুরি আটকানোর চেষ্টা হচ্ছে। সেখানেও গণ্ডগোল। নিয়মিত গুলিবিনিময়ে সীমান্তে যে রকম উত্তপ্ত পরিস্থিতি, তাতে পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ ভর্তি ট্রাক কবে ঢুকতে পারবে, তা নিয়েই সংশয়। কংগ্রেসের নেতারা বলছেন, এই জন্যই তো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক প্রয়োজন।
চিন্তায় পড়েছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতও। পেঁয়াজ যে শুধুই চোখে জল আনে না, গদিও উল্টে দিতে পারে, তা তাঁর থেকে ভাল কেউ জানে না। ১৯৯৮ সালে যখন সুষমা স্বরাজ দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী, তখন এই শীলা দীক্ষিতই পেঁয়াজের দাম নিয়ে আমজনতার ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েছিলেন। পেঁয়াজের দামের ধাক্কাতেই গদি হারায় বিজেপি। তার পর থেকেই শীলা দীক্ষিত টানা ১৫ বছর দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে। কিন্তু এ বার তোপের মুখে শীলা নিজেই। নভেম্বরে দিল্লি বিধানসভার নির্বাচন। তার ঠিক আগে দুঃস্বপ্নের মতো ফিরে এল পেঁয়াজের অগ্নিমূল্য। গদি বাঁচাতে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী সুলভে পেঁয়াজ বিক্রির বন্দোবস্ত করছেন।
মনমোহন-চিদম্বরম, শীলা-সুষমারা অবশ্য প্রথম নন। সেই ইন্দিরা গাঁধীর জমানা থেকেই পেঁয়াজ বারবার সরকারের চোখের জলের কারণ। ইন্দিরা-রাজত্বে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে পেঁয়াজের মালা উপহার দিয়েছিলেন বিরোধীরা। আবার দ্বিতীয় ইউপিএ-জমানার ২০১০ সালেও এই পেঁয়াজ প্রণববাবুকে ভুগিয়ে ছেড়েছিল। তখনও পেঁয়াজের দাম ১০০ ছুঁয়েছিল। তা মনে করিয়ে জামশেদপুরের ব্যবসায়ী সতনম সিংহ গম্ভীর ২০১০ সালের মতো এ বারও গাড়ি ও ট্রাকের টায়ারের সঙ্গে ৫ কিলোগ্রাম করে পেঁয়াজ ফ্রি দিচ্ছেন।
পেঁয়াজের এই দ্বিতীয় সেঞ্চুরির কারণ কী?
মহারাষ্ট্রের নাসিকে অতিবৃষ্টির ফলে পেঁয়াজের উৎপাদন কম হয়েছে। রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে খরার ফলে ৪০ শতাংশ ফলন কম হয়েছে। রাজস্থানে গত বছর পেঁয়াজের অতিরিক্ত ফলন হয়েছিল। তার সব বিক্রি না হওয়ায় চাষিদের ক্ষতি হয়। তাই এমনিতেই এ বার তাঁরা কম পেঁয়াজ চাষ করেছিলেন। কর্নাটকেও অতিবৃষ্টি হচ্ছে। এ সবের সঙ্গে যোগ হয়েছে ফাটকাবাজি। তাই খুচরো বাজারের সঙ্গে পাইকারি বাজারেও পেঁয়াজের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। ভারত তথা এশিয়ায় পেঁয়াজের সবথেকে বড় পাইকারি বাজার নাসিকের লাসালগাঁওতে পেঁয়াজের দাম কিলো প্রতি ৪৬ টাকা ছুঁয়েছে। নাসিকের ন্যাশনাল হর্টিকালচার রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টর আর পি গুপ্তও পাইকারি দাম এত বেড়ে যাওয়ার অবাক। তিনি বলছেন, “২০১০ সালের ডিসেম্বরে যখন পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকা ছুঁয়েছিল, তখনও পাইকারি দাম ৪০ টাকা ছিল। দেশে এই প্রথম খুচরো বাজারে গড় মূল্য এতটা বেড়ে গিয়েছে।” প্রতিষ্ঠানের কর্তারা মনে করছেন, ফাটকাবাজির ফলে পেঁয়াজের দাম ২৫ শতাংশ বেড়েছে। কারণ বেঙ্গালুরু, কলকাতা, পুণের মতো শহরে বড় বাজারগুলিতে পেঁয়াজের যে হারে দাম বেড়েছে, সেই হারে সরবরাহ কমেনি।
কৃষিমন্ত্রী শরদ পওয়ার এর পরেও রফতানি বন্ধ করতে রাজি নন। এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত ৬.৩৬ লক্ষ টন পেঁয়াজ রফতানি হয়েছে। পেঁয়াজ রফতানি করে মহারাষ্ট্রের কৃষকরা মোটা টাকা আয় করেন। রফতানি বন্ধ করে দিলে তাঁদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হবে পওয়ারকে। ফলে আমজনতার সুরাহার বন্দোবস্ত করতে হচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শীলা দীক্ষিতের সরকারকে।
কবে পেঁয়াজের দাম কমবে?
ব্যবসায়ীরা মনে করেন, অন্ধ্রপ্রদেশ ও কর্নাটক থেকে নতুন পেঁয়াজ এলে তবেই দাম কমবে। কিন্তু তা হতে হতেও সেপ্টেম্বরের শেষ। কারণ কর্ণাটকেও অতিবর্ষণ হচ্ছে। দিল্লির আজাদপুর পাইকারি বাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সংগঠনের সভাপতি সুরেন্দর বুধিরাজা বলেন, “খুব তাড়াতাড়ি পেঁয়াজের দাম কমার লক্ষণ দেখছি না। হাল না শোধরালে দু’সপ্তাহের মধ্যে পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকায় পৌঁছবে।”
|