বেআইনি অনুপ্রবেশের অপরাধে মায়ের সঙ্গে জেলে যেতে হয়েছিল পাঁচ বছরের মেয়েটিকে। তার পরে জেলেই মারা যান অসুস্থ মা। এমনই এক দুঃস্থ অভিভাবকহীন শিশুর ভবিষ্যৎ গড়তে হাত মেলাচ্ছে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিএসএফের অনুরোধে মেয়েটিকে শুধু বাড়িতে ফেরানোই নয়, সাবালক হওয়া পর্যন্ত তার পড়াশোনা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব নিচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষার দায়িত্বে থাকা বিজিবি।
|
—নিজস্ব চিত্র |
মা মনোয়ারা বেগম এবং দাদা মুন্না পারভেজের হাত ধরে দক্ষিণ দিনাজপুরের সীমান্ত দিয়ে ২০০৯ সালে বেআইনি ভাবে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে ঢোকে আফরোজা। তিন জনকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয় বিএসএফ। এখান থেকে আলাদা হয়ে যায় ন’বছরের মুন্না। তাকে পাঠানো হয় জেলায় সমাজ কল্যাণ দফতরের একটি হোমে। মনোয়ারার দু’বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। তাঁর ঠাঁই হয় বালুরঘাট সংশোধনাগারে। সে সময়ে আফরোজার বয়স ছিল পাঁচ। তাই মায়ের সঙ্গে সে-ও থেকে যায় সেখানেই। পরে মা-মেয়েকে পাঠানো হয় বহরমপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে।
এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে বহরমপুর জেলেই মৃত্যু হয় মনোয়ারা বেগমের। ইতিমধ্যে সরকারি ছাড়পত্র পেয়ে আফরোজার দাদা মুন্নাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে সমাজকল্যাণ দফতর। কিন্তু ছোট্ট আফরোজাকে বাংলাদেশে পাঠানোর অনুমতি দেয়নি স্বরাষ্ট্র দফতরের বিদেশ সংক্রান্ত শাখা। এ দেশে সম্পূর্ণ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে আফরোজা। কারা দফতরের তৎকালীন আইজি বংশীধর শর্মা ওই সময় উদ্যোগী হয়ে আফরোজার অভিভাবকত্ব নিতে এগিয়ে আসেন। আফরোজাকে তিনি রানাঘাটের একটি বেসরকারি হোমে নিয়ে গিয়ে রাখেন। সেখানে শুরু হয় আফরোজার নতুন জীবন, পড়াশোনাও।
কিন্তু কোনও বাংলাদেশি নাগরিকই অবৈধ ভাবে ভারতে থাকার অনুমতি পেতে পারে না। তোড়জোড় শুরু হয় তাকে বাংলাদেশে পাঠানোর। কিন্তু নানা আইনি জটিলতায় গত চার বছরে তা আর হয়ে ওঠেনি।
এরই মধ্যে বংশীধর শর্মা কারা দফতর থেকে বদলি হয়ে বর্তমানে বিএসএফের এডিজি (পূর্বাঞ্চল)। বিএসএফ-এ যোগ দেওয়ার পরে তিনিই আফরোজাকে বাংলাদেশে তার বাড়ির লোকের কাছে ফেরাতে উদ্যোগী হন। এ বছরের ২০ মে স্বরাষ্ট্র দফতর আফরোজাকে বাংলাদেশে পাঠানোর লিখিত অনুমতিও দিয়ে দেয়। বিএসএফ জানতে পেরেছে, আফরোজার বাড়ি নাটোর জেলার নলডাঙা থানার দাসপাড়া গ্রামে। সেখানেই পাঠানো হবে আফরোজাকে।
কিন্তু শিশুটিকে দেশে ফিরিয়েই দায়িত্ব শেষ করতে চান না বংশীধরবাবু। অভিজ্ঞতা থেকে তিনি দেখেছেন, হতদরিদ্র এই পরিবারগুলির মেয়েরা লেখাপড়া শেখার সুযোগ পায় না। বড় হতে না হতেই আবার পাচার হয়ে যায়। আফরোজার পড়াশোনা চালানো ও নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি-কে তাই চিঠি লেখেন তিনি। বংশীধরবাবু বলেন, “আফরোজাকে হোমে রাখা এবং স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করেছিলাম। সম্প্রতি ওকে দেশে ফেরত পাঠানোর সরকারি ছাড়পত্র পেলেও, শুধুমাত্র বিজিবি-র হাতে তুলে দিয়েই দায়িত্ব এড়াতে চাইনি। তাই বিজিবি-র ডিজি-কে অনুরোধ করেছিলাম, কেবল বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়াই নয়, সাবালক হওয়া পর্যন্ত ওর নিরাপত্তা ও পড়াশোনার বিষয়ে তারা যেন নজরদারি করে।”
বিজিবি-র ডিজি মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ ওই চিঠির উত্তরে জানিয়েছেন, তাঁরা আফরোজার বাড়ি, তাঁর বাবা, দাদা এবং অন্য স্বজনদের খোঁজ পেয়েছেন। শীঘ্রই আফরোজাকে তাঁদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তার পড়াশোনা ও নিরাপত্তার যথাযোগ্য ব্যবস্থা বিজিবি-ই করবে।
কাঁটাতারের দু’পারে পাহারায় থাকা রক্ষীদের এ ভাবেই মিলিয়ে দিতে চলেছে মা-হারা ছোট্ট আফরোজা। |