খিদেতে একটানা ঘ্যানঘ্যান করছিল মাস আটেকের সুনিয়া। বিরক্তিতে মা তার পিঠে থাপ্পড় কষিয়ে দিতেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে সে একেবারে চুপ। পাশে তার থেকেও ছোট একটি শিশু একটানা চিৎকার করে কাঁদছিল।
সে দিকে অবশ্য ভ্রূক্ষেপ নেই কারও। সকলেরই মন পড়ে বিশাল ভাতের কড়াইয়ের দিকে। এঁদেরই এক জন, সালেহার বিবি বলেন, “কী করব বলুন? দুধ কেনার পয়সা নেই কারও কাছে। সকলেই তো একবস্ত্রে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি!”
ত্রাণ শিবিরে দিনে দু’বার ভাত, ডাল আর সাবু। বাচ্চাদের জন্য এখনও দুধের ব্যবস্থা করা যায়নি। তবে রাতে ভাত বাড়তি থাকলে জল দিয়ে রাখা হয়। সকালে সেই ‘পান্তা’ সম্বল। অথচ ওই শিবিরে যাঁরা আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই জমি আছে। সচ্ছল সংসার। মাসখানেক আগেও ওঁদের ঘর ছিল। টিভি ছিল। সাইকেল ছিল। টিনের বাক্সে ছিল বিয়ের লাল টকটকে বেনারসী। এখন সম্বল আত্মীয়ের কাছ থেকে চেয়ে আনা ছেঁড়া শাড়ি। পুরনো জামা। ঠাঁই বলতে নির্মীয়মাণ বাড়ির দরজা-জানালাহীন ঘর, শোওয়ার জন্য সাড়ে তিন হাত ভূমি ঢাকা তেরপল। বোবা চোখে অনন্ত জিজ্ঞাসা‘আমরা কবে বাড়ি ফিরতে পারব বলতে পারেন?’ |
গত ৯ জুলাই নদিয়ার চাপড়ায় হাতিশালা গ্রামে বোমায় বাড়ির সামনেই খুন হয়েছিলেন তৃণমূল কর্মী মিঠু ঘোষ। অভিযোগ সিপিএমের দিকে। ওই সকাল থেকেই গ্রামে ব্যাপক অশান্তি, ভাঙচুর, লুঠপাট। কয়েকটি বাড়িতে আগুনও। বাড়ি-ঘর ফেলে পালায় বহু সিপিএম সমর্থক পরিবার। পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিপিএম-শূন্য ওই এলাকায় ৬টির মধ্যে ৫টি বুথেই হাসতে-হাসতে জিতেছে তৃণমূল। তিনটি বুথে সিপিএম প্রার্থীরা একশোর বেশি ভোট পাননি। সিপিএমের অভিযোগ, তাদের গ্রামছাড়া সমর্থকেরা কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভরসায় ভোট দিতে এলেও খুন ও লুঠপাটের মামলায় পুলিশ তাঁদেরই ১৭ জনকে গ্রেফতার করায় বাকিরা আর যাননি। হাতিশালা-১ পঞ্চায়েতের ও চাপড়া পঞ্চায়েত সমিতির তিনটি আসনে জয়ী হয় তৃণমূল।
কিন্তু এর পরেও গ্রামে ঢুকতে পারছেন না ঘরছাড়ারা। তাঁদের অভিযোগ, কয়েক জন মহিলা গত দু’তিন দিন ধরে ঘরে যাওয়ার চেষ্টা করলেও তাঁদের হুমকি দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। পুরুষেরা ঢোকার চেষ্টা করলে খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছে। গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে বেশির ভাগই আশ্রয় নিয়েছিলেন আশপাশের গ্রামে আত্মীয়ের বাড়ি। পরে নতুনগ্রামে এক দলীয় সমর্থকের নির্মীয়মাণ বাড়িতে শিবির খোলে সিপিএম। তিনটি ঘর। সামনে লম্বা বারান্দা। সেখানেই রাত কাটান শিশু-বৃদ্ধ মিলিয়ে আটশো মানুষ। সেখানেও যাঁদের জায়গা হয় না, তাঁরা চলে যান ছাদে। বৃষ্টি হলে বারান্দার এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে থাকতে হয়। বাকিরা রাতটুকু থাকেন গ্রামের বিভিন্ন আত্মীয়ের বাড়িতে। তারজিনা বিবি, মমতাজ বিবিরা বলেন, “কত দিন আর আত্মীয়ের বাড়িতে থাকা যায় বলুন? ত্রাণ শিবির না হলে রাস্তায় আকাশের নীচে দাঁড়াতে হত।”
নদিয়ার জেলাশাসক পি বি সালিম বলেন, “শ’খানেক পরিবার ওই শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানতে পেরেছি। দু’পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে সমাধানসূত্র বার করে ঘরছাড়াদের ফেরানোর চেষ্টা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণও দেওয়া হবে।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত বলেন, “আমাদের কর্মী খুন হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই এলাকায় ক্ষোভ রয়েছে। তবে নারী-শিশুদের বিষয়টি আমরা মানবিক ভাবে বিচার করছি।”
কিন্তু এ ভারে আর কত দিন?
পরনের নোংরা লুঙ্গি গুটিয়ে হতাশ গলায় বছর পঁচাশির জাকির শেখ বলেন, “ক’দিন আগেও গোলা ভরা ধান ছিল। মাঠে পাট ছিল। তৃণমূলের লোকজন সব পাট কেটে দিয়েছে। কী ভাবে ঈদ চলে গেল! ছোটদের একটা নতুন জামাও কিনে দিতে পারলাম না। সত্যিই কি আর কোনও দিন ঘরে ফিরতে পারব না! মাঠে ধান রুইতে পারব না!”
|