গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা কি জবরদস্তি পাহাড়বাসীর উপরে বনধ চাপিয়ে দিয়েছে? নাকি পাহাড়ের মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বনধ সমর্থন করছেন? প্রশ্ন তুলেছেন খোদ মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ।
অন্তত, বিমল গুরুঙ্গের ‘ফেসবুক অ্যাকাউন্ট’ সে কথাই বলছে। এই প্রশ্ন সেখানে ‘পোস্ট’ করে আমজনতার সমর্থন বা বিক্ষোভের মাত্রা কতটা, বোঝার চেষ্টা করছেন মোর্চার শীর্ষ নেতা। ওই প্রশ্নের উত্তরে এসেছে অনেক প্রতিক্রিয়াও। দেখা যাচ্ছে, সিংহভাগ বনধ সমর্থন করেছেন ঠিকই, কিন্তু একাংশ খোলাখুলি বনধ বিরোধিতা করেছেন। কেউ আবার গুরুঙ্গকে পরামর্শ দিয়েছেন, সুবাস ঘিসিংয়ের পথে হেঁটে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি যেন না হয়।
মোর্চা সূত্রের খবর, বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সংখ্যা সামান্য হলেও, বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা ভাবতে হচ্ছে গুরুঙ্গদের। কারণ ওই সব খোলাখুলি বক্তব্যে মানুষের ক্ষোভ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কয়েক জন স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, মোর্চার বনধ কোনও ভাবেই সমর্থন করা যায় না। দিনের পর দিন জনজীবন বিপর্যস্ত করছে যে বনধ, তা চাপিয়ে দেওয়ার আগে পাহাড়বাসীর মতামত নেওয়া উচিত ছিল, মনে করছেন তাঁরা।
একজন তাঁর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে লিখেছেন, ‘আপনি পাহাড়ে যদি আলাদা রাজ্যের দাবিতে আন্দোলনই করবেন, তা হলে জিটিএ নিলেন কেন? যদি জিটিএ নিলেন, তা হলে তা না চালিয়ে কেনই বা সরে গেলেন?’ এমনকী, অতীতে সুবাস ঘিসিং দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পরে যে ভাবে দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদ গড়েছিলেন, সেই রাস্তায় হেঁটে জিটিএ গড়ার আগে কেন গুরুঙ্গ ভাবলেন না, সেই প্রশ্নও ছুড়ে দিয়েছেন ওই প্রতিক্রিয়ায়।
ফলে বন্ধে বিপন্ন পাহাড়বাসীদের ক্ষোভ ধীরে ধীরে যে দানা বাঁধছে, সেই সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারেননি মোর্চা নেতাদের অনেকে। মোর্চা নেতারাও দ্রুত অচলাবস্থা কাটানোর উপায় খোঁজার উপরে জোর দিয়েছেন, খবর মিলেছে মোর্চাসূত্রে। ‘বিমল গুরুঙ্গ অফিসিয়াল’ নামের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে নিয়মিত নিজস্ব মতামত, আন্দোলনের বৃত্তান্ত জানিয়ে দেন মোর্চা সভাপতি। বৃহস্পতিবার দুপুরে সেই অ্যাকাউন্টেই বনধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন রাখেন তিনি। শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত সেখানে ১৮৫ জনের মতামত দেখা গিয়েছে। অধিকাংশ বনধ সমর্থন করে গুরুঙ্গের পাশে রয়েছেন বলে দাবি করেছেন। আলাদা গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে তাঁরা সবরকম ‘ত্যাগ’ স্বীকার করতে প্রস্তুত বলেও বার্তা দিয়েছেন। পক্ষান্তরে, সুবাস ঘিসিংয়ের পথে হাঁটার ভুল সংশোধনের পরামর্শও সংযোজিত হয়েছে ফেসবুকে।
ফেসবুকে গুরুঙ্গ এই প্রশ্ন রাখায় অবাক হয়েছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ অনেকেই। মোর্চা সভাপতির বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন ধরেই অভিযোগ রয়েছে যে তিনি সমালোচনা সহ্য করতে অভ্যস্ত নন। পাহাড়ের কেউ তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করলে নানা ভাবে তাঁকে সমস্যায় পড়তে হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। মোর্চার অন্দরের খবর, যে কোনও বৈঠকে শেষ পর্যন্ত গুরুঙ্গের সিদ্ধান্তই বহাল থাকে। সম্প্রতি তেলঙ্গানা গঠনের ব্যাপারে কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে একাধিক বৈঠকে বিরুদ্ধ মতামত শুনে গুরুঙ্গের মেজাজ হারিয়ে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে।
তা হলে কি গুরুঙ্গ বনধ নিয়ে দ্বন্দ্বে ভুগছেন? মোর্চা সূত্রেই জানা গিয়েছে, সাম্প্রতিক টানা বন্ধের জেরে পাহাড়ের ভুক্তভোগীরা অনেকেই সুবাস ঘিসিংয়ের সঙ্গে গুরুঙ্গের তুলনা শুরু করেছেন। সে খবর পৌঁছেছে মোর্চার সদর দফতরেও। বিশেষত, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অনেকে সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ করে এ ভাবে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত একতরফা ভাবে নেওয়াটা মেনে নিতে পারছেন না বলেও মোর্চা নেতারা অনেকে বুঝতে পেরেছেন।
সম্প্রতি ওই বিষয়ে স্পষ্ট কিছু তথ্য পাওয়ার পরে দলীয় দফতরে এক বৈঠকের পরে গুরুঙ্গ ও তাঁর একান্ত ঘনিষ্ঠরা সিদ্ধান্ত নেন, গুরুঙ্গ যে ঘিসিংয়ের মতো সব ক্ষেত্রে নিজের মত চাপিয়ে দেন না সেই বার্তা তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। সেই সঙ্গে বিরুদ্ধ সমালোচনা হলেও গুরুঙ্গ যে তা শুনতে চান, সেই বার্তাও দেওয়া জরুরি বলে গুরুঙ্গ-ঘনিষ্ঠরা পরামর্শ দেন। এর পরেই গুরুঙ্গ তাঁর স্বভাব-বিরোধী পথে হেঁটে সকলের মতামতের জন্য প্রশ্ন রাখার ব্যাপারে সহমত হন।
কিন্তু, পাহাড়ের শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের একটা অংশ নয়া তথ্য-প্রযুক্তিতে স্বচ্ছন্দ হলেও, বাকি বিশাল অংশ ‘ফেসবুক’-এর দুনিয়ার বাইরে থাকেন। পাহাড়ের ৮টি ব্লক ও ৩টি পুর এলাকার সেই সব বাসিন্দাদের মধ্যে বনধ ঘিরে ক্ষোভ দানা বাঁধছে কি না তার হদিস কী ভাবে করা যাবে? এখন সেই প্রশ্নকে ঘিরেই মোর্চার অন্দরে উদ্বেগ বাড়ছে।
|