বনধের সপ্তম দিনে টক্করের নতুন ক্ষেত্র
রাজ্যের কেবল বন্ধের পাল্টা গুরুঙ্গের মোবাইল-হুঁশিয়ারি
প্রথমে রাজ্য প্রশাসনের অভিযানে বন্ধ হয়ে গেল দার্জিলিঙের কেবল টিভি পরিষেবা। এই ঘটনার পরেই পাল্টা হুমকি দিলেন বিমল গুরুঙ্গ। পরিবেশ দূষণের দায়ে তিনি মোবাইল পরিষেবা বন্ধের হুঁশিয়ারি দিলেন। ফলে, এক সপ্তাহ ধরে চলতে থাকা টানা বন্ধে বিপর্যস্ত পাহাড়ে সম্প্রতি যে এক চিলতে আলোচনার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তা-ও ঢেকে গেল দু’পক্ষের টক্করের মেঘে।
পাহাড় নিয়ে রাজ্য প্রশাসন যে কোনও রকম নমনীয়তা দেখাবে না, সেটা মোর্চার আন্দোলনের প্রথম দিন থেকেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন রেড রোর্ডে ঈদের নমাজের পরেও তিনি জানিয়ে দেন, কেউ যদি রাজ্য টুকরো টুকরো করতে চায়, তা হলে সেটা প্রয়োজনে জীবন দিয়ে রুখবেন তিনি। পাহাড়ে সিআরপি নামানো থেকে শুরু করে পুরনো মামলা তুলে এনে মোর্চা সদস্যদের ধরপাকড়ের মধ্যে দিয়ে প্রশাসন চাপটা ক্রমে বাড়িয়েই চলেছে। এ দিন এর সঙ্গে যোগ হল কেব্ল পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া।
পুলিশ-প্রশাসনের কেউ অবশ্য এই ঘটনা নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে দার্জিলিঙের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন কিংবা এসপি কুণাল অগ্রবাল দু’জনেরই বক্তব্য, “যথা সময়ে যা বলার বলব।” তবে মোর্চা নেতাদের অনেকেরই সন্দেহ, ওই দু’টি সংস্থার চ্যানেলে মোর্চার আন্দোলনের খবর সারাদিন সম্প্রচার করা হয়ে থাকে বলে তা বন্ধ করেছে সরকার। তাঁদের বক্তব্য, সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল স্থানীয় কেব্ল নিউজ চ্যানেলগুলি বন্ধ করা। কিন্তু সরাসরি তা না করে কেব্ল নেটওয়ার্ক দু’টিই বন্ধ করে দেওয়া হল। ডিটিএইচ বা ডাইরেক্ট টু হোম পরিষেবাগুলি কিন্তু এর আওতায় আসছে না। মোর্চা নেতাদের একটি অংশ বলছে, তাতে অবশ্য সমস্যা নেই। কারণ, স্থানীয় খবরের চ্যানেলগুলি ডিটিএইচ পরিষেবায় দেখা যায় না। এই পরিস্থিতিতে মোর্চার সহকারী সাধারণ সম্পাদক বিনয় তামাঙের বক্তব্য, “দু-চার দিন সম্প্রচার বন্ধ করে আমাদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন কমানো যাবে না। বরং বাড়বে। এটা রাজ্য সরকার না বুঝলে ভুল করবে।”
রেড রোডে ঈদের জমায়েতে মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য
প্রশাসন সূত্রের খবর, দার্জিলিং জেলা সদরে লাডেন লা রোড ও হিলকার্ট রোডে যে দু’টি কেব্ল নেটওয়ার্কের অফিস রয়েছে, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ সেখানে অভিযান হয়। এই নেটওয়ার্ক চালাতে গেলে যে সব নথিপত্র দরকার, তা ওই সংস্থা দু’টির ছিল না বলেই দাবি পুলিশ-প্রশাসনের। প্রশ্ন হচ্ছে, কেব্ল নেটওয়ার্ক চালাতে গেলে কেব্ল অপারেটরদের কী কী নথি থাকা প্রয়োজন? প্রশাসন সূত্রে বলা হয়েছে, এর জন্য সর্বাগ্রে চাই কেব্ল নেটওয়ার্ক চালানোর রেজিস্ট্রেশন। তা ছাড়া, যে সব যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, তা ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড অনুমোদিত কি না, কপিরাইট বিধি মেনে বিনোদন অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে কি না, সেই সংক্রান্ত নথিও রাখতে হয়। দমকলের ছাড়পত্রও জরুরি। ওই সংস্থা দু’টির নিজস্ব তিনটি দিনরাতের নিউজ চ্যানেল আছে। তার জন্যও পৃথক রেজিস্ট্রেশন প্রয়োজন। এর কোনও নথিই সংস্থা দু’টি দেখাতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে সাময়িক ভাবে ওই দুই কেব্ল অপারেটরকে সম্প্রচার বন্ধ রাখতে বলা হয়। জেলা পুলিশ-প্রশাসনের বক্তব্য, ওই সমস্ত নথিপত্র দেখানোর জন্য সোমবার সংস্থার কর্তাদের ডাকা হয়েছে।
ওই কেব্ল অপারেটরদের অবশ্য অভিযোগ, একটি সাদা কাগজে হাতে-লেখা নির্দেশ দিয়ে সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছেন জেলা প্রশাসনের কর্তারা। কড়া সমালোচনা করেছেন গুরুঙ্গও। এই ঘটনাকে ‘রাজ্য সরকারের স্বৈরাচারী পদক্ষেপের অন্যতম দৃষ্টান্ত’ বলে উল্লেখ করে তাঁর বক্তব্য, “রাজ্যপাল থেকে মুখ্যমন্ত্রী, যিনি যত বার পাহাড়ে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন, ওই সব কেব্ল চ্যানেলের ‘নিউজ নেটওয়ার্ক’-এর মাধ্যমে তা ‘লাইভ’ দেখানো হয়েছে। তখন তো আপত্তি ওঠেনি। এখন এ সব করা হচ্ছে।” এর পরেই গুরুঙ্গের অভিযোগ, “আমাদের আন্দোলন রুখতে রাজ্য সরকার কী ধরনের স্বৈরাচারী পদক্ষেপ করছে, এটা তার অন্যতম দৃষ্টান্ত। এ তো মানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ! আসলে পাহাড়ের স্থানীয় সংবাদ চ্যানেলগুলিকে বন্ধ করে আন্দোলন দমাতে চাইছে সরকার। কিন্তু, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা পাহাড়বাসী তো নয়ই, গোটা বিশ্বের কেউই বরদাস্ত করবেন না।” এই ঘটনার সমালোচনা করে প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যও বলেছেন, “পাহাড়ের মানুষকে সংবাদ দেখা থেকে বঞ্চিত করা গণতন্ত্র বিরোধী। যাঁরা সম্প্রচার করছে তাঁদের নথিপত্রে ত্রুটি থাকলে নোটিস দেওয়া যেতে পারে। এ ভাবে সম্প্রচার বন্ধ করা বেআইনি।”
এর পরেই পরিবেশ দূষণের কথা তুলে মোবাইল পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন বিমল গুরুঙ্গ।
গুরুঙ্গের এই হুমকি অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। তিনি বলেছেন, “কেউ দুমদাম কিছু বলতেই পারেন। তার প্রতিক্রিয়া দেব না।” একই সঙ্গে পাহাড়ে শান্তিরক্ষার দায় জিটিএ সদস্যদের ওপরে দিয়ে তিনি বলেছেন, “দার্জিলিং পাহাড়ে শান্তি বজায় রাখার দায়িত্ব জিটিএ সদস্যদেরও। কোনও ভাবে উস্কানি দিয়ে পরিস্থিতি অশান্ত করার চেষ্টা মেনে নেওয়া যাবে না। আমরা চাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক রেখে পাহাড়ের উন্নয়ন, জিটিএ-কে আরও গতিশীল করা নিয়ে আলোচনা হোক। মোর্চাকেও আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।”
মোবাইল টাওয়ারের জন্য মানুষ বা জীবজন্তুর স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে বলে যে অভিযোগ গুরুঙ্গ তুলেছেন, তা উড়িয়ে দিয়েছে মোবাইল পরিষেবা সংস্থা এবং টাওয়ার সংস্থাগুলির অ্যাসোসিয়েশন, দু’পক্ষই। মোর্চার ওই অভিযোগের পিছনে বাস্তবতার চেয়ে রাজনীতিই বেশি বলে মনে করছে টেলিকম শিল্প মহল। তারা আরও দাবি করেছে, কোনও প্রমাণ ছাড়া টাওয়ার বন্ধ করা, তুলে দেওয়া বা টাওয়ারের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া সর্ম্পূণ বেআইনি। তাঁদের বক্তব্য, কোনও টাওয়ার নিয়ে অভিযোগ থাকলে তা যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকারী একমাত্র টেলিকম দফতরের আঞ্চলিক কার্যালয়গুলি। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা সত্যিই তাদের হুমকি কার্যকর করতে চাইলে রাজ্য সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চাইবে বলে জানিয়েছে সেলুলার অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া (সিওএআই) ও টাওয়ার অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন (টাইপা)।
অন্য দিকে, দার্জিলিঙের কেব্ল অপারেটরেরা দাবি করেছেন, তাঁদের কাছে সব নথিপত্রই রয়েছে। কিন্তু তা দেখানোর জন্য নোটিস না দিয়ে রাতারাতি চ্যানেল বন্ধ করার আড়ালে অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে। দার্জিলিং কম্বাইন কেব্ল নেটওয়ার্কের কর্ণধার কুমার দেওয়ানর অভিযোগ, এক টুকরো কাগজে কোনও রকম সরকারি স্ট্যাম্প ছাড়াই সম্প্রচার বন্ধের নোটিস দেওয়া হয়েছে। ‘মিল্কি ওয়ে’ নামে অন্য কেব্ল অপারেটর সংস্থার মালিক সুধীর রাই একই অভিযোগ করে বলেছেন, “কাগজপত্রগুলি কন্ট্রোল রুমে হাতের কাছে ছিল না। তাতেই সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হল।” অপারেটরদের তরফে কয়েক জন দাবি করেছেন, মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা বিক্রয় কর এবং ২৫ হাজার টাকা বিনোদন কর দেন তাঁরা। এই সংস্থা দু’টিকে এত দিন নিয়মিত সরকারি অনুষ্ঠানেও ডাকা হতো। অপারেটরেরা বলছেন, এই ভাবে প্রয়োজনীয় নথি রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখে সম্প্রচার বন্ধ করার ঘটনা অতীতে ঘটেনি।
তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য মনে করছেন, এই চাপ বজায় রাখলে শীঘ্রই পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে। এ দিনই ঝাড়গ্রামে এক অনুষ্ঠানে শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে রাজ্য সরকার এই সমস্যার মোকাবিলা করতে পারবে। জঙ্গলমহলে শান্তি এসেছে। পাহাড়েও শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারবে সরকার।”

কিছু লোক রাজ্য টুকরো টুকরো করে দিতে চায়। আমি জীবন দিতে তৈরি, কিন্তু (রাজ্য) ভাগ হতে দেব না (হাম জিন্দেগি দেনে কে লিয়ে ভি তৈয়ার হ্যায়, লেকিন বাটনে নেহি দেঙ্গে)।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.