|
|
|
|
রাজনীতির চক্রান্তেই ইটের পাঁচিল আজ দুর্গার চোরাবালি
জয়ন্ত ঘোষাল • কদলপুর (গ্রেটার নয়ডা) |
রাজধানী থেকে মেরেকেটে এক ঘণ্টার রাস্তা। অঙ্কের হিসেবে ১২৫ কিলোমিটারের বেশি নয়! কিন্তু কদলপুরে পা দিলে মনে হবে, এটাই বুঝি ভারতের প্রত্যন্ততম গ্রাম।
গ্রামের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ মুসলমান। খুশির ঈদ আজ। মাটির বাড়ির সামনে লাল-হলুদ-সবুজ কাগজের শিকলি। নতুন জামাকাপড়, মাথায় সাদা টুপি। গ্রামপ্রধান সফিক খানের বাড়িতে বিরিয়ানি হয়েছে। আজ সেখানেই গ্রামবাসীদের ভোজসভা।
কাঁচা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মসজিদটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। নমাজ পড়া শেষ হয়ে গিয়েছে। পাশেই সেই ভাঙা পাঁচিলটা। উত্তরপ্রদেশ সরকার এই পাঁচিল ভাঙার দায়েই সাসপেন্ড করেছে মহকুমাশাসক দুর্গাশক্তি নাগপালকে।
|
দুর্গাশক্তি |
মুলায়ম সিংহ যাদব ও তাঁর পুত্র অখিলেশের অভিযোগ, এই পাঁচিল অবৈধ নির্মাণ হতে পারে। কিন্তু রমজান মাসে পাঁচিল ভেঙে সংখ্যালঘু আবেগে আঘাত করেছেন দুর্গা।
গ্রামপ্রধান সফিক খান বলছেন, “গত দশ বছর ধরে এই মসজিদে গ্রামের মানুষ নমাজ পড়ছে। এই ছোট্ট গ্রামে আর তো কোনও মসজিদ নেই। গ্রামের গরিব মানুষ চাঁদা তুলে চার লাখ টাকা জমিয়ে এই দেওয়াল তৈরি করে। ২৭ জুলাই জেলা প্রশাসনের লোকেরা এসে বুলডোজার দিয়ে এই পাঁচিল ভেঙে দিয়েছে।”
আপনারা জানতেন না এই দেওয়াল নির্মাণ অবৈধ?
গ্রামপ্রধান বলছেন, “জানতাম না। জানার পর বলেছিলাম, রমজান মাসে ভেঙো না। দুর্গা সে কথা শোনেননি।” এক পাল মুরগি এ দিক ও দিক ছড়িয়েছিটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মসজিদের ইমামও খুব রেগে আছেন দুর্গার উপরে। ইমামের প্রশ্ন, সমাজবাদী পার্টির সাংসদ নরেন্দ্র ভাট্টি এই মসজিদে এসেছিলেন। দেওয়াল যে দিন তৈরি হল সে দিনও তিনি নিজে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তা হলে এই দেওয়াল অবৈধ হয়ে গেল কী করে?
সঙ্গত প্রশ্ন। কিন্তু দুর্গাই যে পাঁচিল ভেঙেছেন, সেটা জানা গেল কী করে? দেওয়াল তৈরির দিন নরেন্দ্র ভাট্টিকে সব্বাই দেখেছিল। দেওয়াল ভাঙার দিন দুর্গাকে কারা দেখেছে? এ বার কিন্তু আশ্চর্য নীরবতা। যেন ভূতের গল্প! সবাই জানে ভূত আছে, কিন্তু স্বচক্ষে দেখেনি কেউ! তা হলে গোটা দেশের মানুষ যখন দুর্গার হয়ে গলা ফাটাচ্ছে, তখন কদলপুরের গরিবগুর্বো মানুষগুলো দুর্গার উপরে এত রেগে গেল কেন? |
সেই ভাঙা পাঁচিল। —নিজস্ব চিত্র |
মসজিদে ঈদের জটলা। সেখানেই প্রশ্নটা করলাম। ৬৭ বছরের জাহিদা বেগম বললেন, “আমরা তো দেখিনি। আমাদের কিছু লোক এসে বলল, দুর্গা ম্যাডাম দেওয়াল ভেঙেছেন। তোমরা প্রতিবাদ করো।” কারা বলল? জাহিদার বলিষ্ঠ শরীরে চোখের আঁচ নিভু নিভু। “সমাজবাদী পার্টির নেতারা এসে বলে গেল, রমজান মাসে পাঁচিল ভেঙেছে দুর্গাশক্তি।”
নিমেষে বুঝলাম, পার্লামেন্টে বসে বা সাংবাদিক বৈঠকের মাইক্রোফোনে এ কাহিনির তল পাওয়া শক্ত।
এ বার চলে আসি সেনাবাহিনীর ওয়েলফেয়ার হাউসিং অ্যাপার্টমেন্টে। গুরুজিন্দর বিহার। প্রায় তিন হাজার ফ্ল্যাট রয়েছে এখানে। কিন্তু দুর্গা উধাও। যে দিন দুর্গাকে সাসপেন্ড করা হল, সে দিনই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চলে এসেছিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ‘ম্যাডাম, আপনি বিদ্রোহিনি। আপনি এ বার দিল্লি নির্বাচনে প্রার্থী হোন।’ গভীর রাত পর্যন্ত পীড়াপীড়ি। কিন্তু উত্তরপ্রদেশ আইএএস অফিসার অ্যাসোসিয়েশনের পার্থসারথি সেনশর্মা দুর্গাকে কেবল একটিই পরামর্শ দিয়ে রেখেছেন, “কোনও কথা বলবেন না। আমলারা কথা বলে না। মিডিয়া যাই বলুক, ওই ফাঁদে পা দেবেন না।”
২৮ বছরের দুর্গা এখন তাই গোপন আস্তানায়। বৈঠকখানার দেওয়ালে সাদা-কালো ছবি। গভীর কালো শীতল চোখ। শ্বশুরমশাই প্রাক্তন আইপিএস অফিসার কৃপা শঙ্কর। বললেন, “বউমা আমার ছেলের চেয়েও বেশি সাহসী। কিন্তু এখন কথা বলা বারণ। শুধু এটুকু বলছি, গত এক বছর ধরে ও যে ভাবে বালি-মাফিয়াদের বিষদাঁত ভেঙে দিচ্ছিল, তাতে আমি নিজে পুরনো আইপিএস হয়ে বুঝতে পারছিলাম খুব শিগগির আঘাত আসবে। আমি আর ছেলে ওকে কম সাবধান করিনি।” শ্বশুরমশাই নিজে যথেষ্ট টেনশনে আছেন। আজই সন্ধ্যায় দিল্লির বাইরে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে।
অ্যাপার্টমেন্টের অন্য বাসিন্দাদের মধ্যে কেউ প্রাক্তন সেনা অফিসার, কেউ বর্তমান আমলা তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য, যমুনার তীর থেকে অবৈধ বালি খনন দীর্ঘ দিনের ব্যবসা। সবাই জানে, গ্রেটার নয়ডায় এখন নির্মাণ ব্যবসার রমরমা। আর এই সব নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় বালি তোলা হয় যমুনার তীর থেকে। বিনে পয়সার ভোজ! প্রাকৃতিক সম্পদে তোমার-আমার সবার অধিকার। উত্তরপ্রদেশ সরকারের মন্ত্রী আজম খান নিজে বলেছিলেন, “এ তো কারও বাবার সম্পত্তি নয়। দেশের সম্পত্তি। তোমরা সবাই লুঠ করো।” গরিব মানুষ ওখানে লাইন দিয়ে বস্তা বস্তা বালি তোলে। সামান্য পয়সা পায়। বালি ওঠে লরিতে। তার থেকেই তৈরি হয় রিয়েল এস্টেট। কোটি কোটি টাকার মুনাফা। ক’দিন আগে পন্টি চাড্ডার হত্যাকাণ্ডে এই ব্যবসার হালহকিকত কিছুটা প্রকাশ্যে আসে। এই এলাকার বহু মানুষেরই অবস্থা এখন ‘খোসলা কা ঘোসলা’ ছবির ত্রস্ত-বিধ্বস্ত অনুপম খেরের মতো।
পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে হিন্দোন বলে একটা নদী ছিল। শুধু অবৈধ বালি খননের জেরে আজ সেই নদী সরস্বতীর দশা পেয়েছে। এ বারের বর্ষায় যমুনার জল উপচে স্থানীয় লক্ষ্মীনগর বস্তি ভাসিয়ে দিয়েছে। ভেসেছে গাজিয়াবাদ। এর জন্য বালির অভাবকেই বিশেষজ্ঞরা দায়ী করেছেন। বন্যার জন্য নয়ডা ‘হাই থ্রেট জোন’, বলছে সরকারই।
এই অবৈধ বালি খনন ব্যবসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নাম দুর্গাশক্তি নাগপাল। স্থানীয় আমলারা ওঁকে সংক্ষেপে ডিএসএন বলে ডাকেন। গত ছ’মাসে মোট ১০৪ জনকে গ্রেফতার করেছেন। বাজেয়াপ্ত করেছেন ৮১টা গাড়ি। ব্যবসায়ীদের কাছে ৬-৭ কোটির জরিমানা চেয়ে নোটিস পাঠিয়েছেন।
দুর্গার এই সব কাজকর্মে কাদের খুব অসুবিধা হচ্ছে? নয়ডার মানুষ এক বাক্যে যার নাম বলছেন, তিনি সমাজবাদী পার্টির সাংসদ নরেন্দ্র ভাট্টি। বৃত্তটা সম্পূর্ণ হল?
নয়ডার ছোট ছোট চায়ের দোকানেও এখন দুর্গাকে নিয়েই আলোচনা। ১৮ নম্বর সেক্টরে একটি মলের বাইরে তেমনই একটা দোকানে বসে স্থানীয় বাসিন্দারা সমস্বরে অভিযোগ করলেন, দুর্গাকে আসলে আগেই সরানোর সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তটা কার্যকর করতে একটা ছুতো দরকার ছিল। পাঁচিল ভাঙাটা সেই ছুতো।
কিন্তু রমজান মাসে মসজিদের পাঁচিল ভাঙার ঝুঁকি দুর্গা নিলেন কেন? আবার সেই গোড়ার প্রশ্নটা ফিরে আসে। দুর্গা কি সত্যিই ভেঙেছেন পাঁচিল? নাকি পাঁচিল ভাঙার দায়টা ওঁর উপরে চাপিয়ে দিয়ে লোক খেপাচ্ছেন নরেন্দ্র ভাট্টি? ঘটনা পরম্পরা ভাল করে নজর করলে কিন্তু সেই সন্দেহই মজবুত হয়।
প্রথমত, দুর্গা মহকুমাশাসক। পাঁচিল ভাঙার নির্দেশ দিয়েছেন জেলাশাসক। দুর্গা এখানে হুকুম তামিল করার বেশি কিছুই করতে পারেন না। দুর্গা নিজে মুখ্যসচিবের সঙ্গে দেখা করে জানিয়েছেন, পাঁচিল ভাঙার প্রশাসনিক নির্দেশ এসেছিল জেলাশাসকের কাছ থেকে।
জেলাশাসক কুমার রবিকান্ত সিংহ কী বলছেন? তাঁর রিপোর্টে স্পষ্ট বলা আছে, দুর্গা নিজে ওই পাঁচিল ভাঙেননি। দুর্গা নিজে সে দিন ঘটনাস্থলে হাজির ছিলেন না। আরও একটা কথা লিখেছেন রবিকান্ত। সেটা হল, পাঁচিল ভাঙার নির্দেশ তিনি নিজেও দেননি। নির্দেশ এসেছিল লখনউয়ের সদর দফতর থেকে।
নরেন্দ্র ভাট্টিরা অনেক আটঘাট বেঁধেই অতএব দুর্গার বিরুদ্ধে নেমেছেন বলে বিভিন্ন মহলের অনুমান। নিজেরাই পাঁচিল ভেঙেছেন আর নিজেরাই কায়দা করে তার দোষটা দুর্গার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন বলে তাঁদের ধারণা। কদলপুরের মানুষ অত শত না বুঝে তাই দুর্গার উপরেই রেগে বসে আছেন। অবশ্য সেটাও বোধহয় পুরো ঠিক বলা হল না। পিপলি লাইভ-এর মতো কদলপুর লাইভ-ও তো চলছে সমানে! এ যেন দুর্নীতি আর সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতির ল্যাবরেটরি! গ্রামের মানুষও টিভি দেখছেন! দুর্গাকে দায়ী করা ঠিক হচ্ছে কি না, এ প্রশ্ন তাঁদের মনেও এসেছে। খুশির ঈদে দুর্গার প্রতি তাঁদের রাগ একটু হলেও পড়তে শুরু করেছে।
২৮ বছরের দুর্গা পঞ্জাব ক্যাডারের আইএএস। স্বামী উত্তরপ্রদেশ ক্যাডারের অফিসার বলে তিনি ডেপুটেশনে উত্তরপ্রদেশে এসেছেন। তাঁর সাসপেনশন প্রত্যাহার করার জন্য পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশের কাছে অনুরোধ করেছেন। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যসচিব জাভেদ উসমানি এবং ক্যাবিনেট সচিব অজিত শেঠও দুর্গার পাশে। ঈদের পর এ নিয়ে ভাবার আশ্বাস দিয়েছেন অখিলেশ। কিন্তু বালি মাফিয়াদের চোখরাঙানিতে সে আশ্বাসও বালির বাঁধ হয়ে যাবে না তো? |
পুরনো খবর: দুর্গাশক্তির বন্ধুকে খতম করার চেষ্টা বালি মাফিয়ার |
|
|
|
|
|