জ্ঞানগুরুর তারিফ না করে উপায় নেই
কুড়ি বছর হয়ে গেল শাহরুখ খানকে চিনি।
অনেক মুহূর্ত একসঙ্গে কাটিয়েছি। ‘ম্যঁয় হুঁ না’, ‘ওম শান্তি ওম’-এর মতো ছবি বানিয়েছি দু’জনে। ঝগড়া হয়েছে প্রচুর। এমনকী আমার বিয়েতে কন্যাদানও করেছে ও।
সত্যি, নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান মনে করি এটা ভেবে যে আজ মন্নতের এক সদস্য হয়ে উঠেছি আমি।
কিন্তু আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি এই গুণগুলো ছিল বলেই কুড়ি বছরে দিল্লির শাহরুখ থেকে সুপারস্টার শাহরুখ খান হয়ে উঠেছে ও।
কী সেই অনন্য গুণগুলো?

একসঙ্গে একশোটা জিনিস করার আসুরিক ক্ষমতা
শাহরুখ কী রকম জানেন?
ধরুন সকাল এগারোটা বাজে। সে দিন ওর একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আমেরিকার একটি বহুজাতিক সংস্থার উঁচু দরের মার্কেটিং টিমের সঙ্গে। সেটার আগে দেখবেন শাহরুখ আরামসে লাইব্রেরিতে কেকেআর নিয়ে মিটিং করছে। আবার তার পরেই গিয়ে ওই মিটিংটাও করল। সেই মিটিংটার পরবর্তী অংশটা পিছিয়ে দিল বিকেলের দিকে। এই মাঝের সময়টায় গিয়ে ফিল্মফেয়ার-এর কভার শ্যুটটা শেষ করে এল। বাড়ি ফিরে মিটিং সেরেই আবার সুহানার হোমওয়ার্ক নিয়ে বসল। এরই মাঝখানে দু’টো স্ক্রিপ্ট দেখল কফি খেতে খেতে। এর পরই হয়তো আমাদের সঙ্গে মিটিং। সেটা করতে করতেই আইপ্যাডে একটা নতুন গেম ডাউনলোড করল। তার পরই সেই গেমটা দেখাল আরিয়ানকে। আমাদের মিটিং শেষ করেই কোনও মিউজিক লঞ্চে গিয়ে একটা বক্তৃতা দিল। রাতে পার্টিতে মুখ দেখাতেই হবে বলে সেখানেও গেল। বাড়ি ফিরে মার্কেটিংয়ের উপর নতুন বইটা একটু পড়ে ঘুমোল।
এটাই কিন্তু ওর প্রতিদিনের রুটিন। এই এতগুলো কাজ ও একদিনে কী ভাবে করে আমি আজও বুঝিনি। এবং প্রত্যেকটা কাজের সময় মনে হবে ও পুরোপুরি মনোযোগ দিয়েই কাজটা করছে। এটা আমার কাছে শাহরুখের ‘শাহরুখ খান’ হয়ে ওঠার আসল চাবিকাঠি।


পিকচার আভি বাকি হ্যায়

কিং-সাইজ দিল
অনেকেই জানেন, আমার সঙ্গে ওর একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। তার পর আজ আমরা আবার একসঙ্গে। এক মাসের মধ্যে আমার পরের ছবির কাজ শুরু করবে ও।
এই যে সব ঝামেলা মিটে গিয়েছে আজ, সেটার জন্য কিন্তু বলছি না ওর হৃদয়টা বড়।
আমি বলছি এটা ভেবে যে আমি শাহরুখকে দেখেছি কী অম্লান বদনে, নিরাসক্ত ভাবে ও জিনিস বিলোতে পারে!
ওর ড্রাইভার হতে পারে, ওর ক্যামেরাম্যান হতে পারে বা হোটেলের বাটলার। আমিও হতে পারি। এত বড় মন যে কারও থাকতে পারে, আমি জানতাম না যদি শাহরুখ খানকে না-দেখতাম। ছোটবেলা থেকে এই ইন্ডাস্ট্রিতে আছি বলে জানি এখানে মানুষ কী কঞ্জুস হতে পারে! এমন লোকও আছেন যাঁদের বাড়ি গেলে আপনাকে জলও খেতে দেবে না। এ রকম একটা ইন্ডাস্ট্রিতে শাহরুখ ব্যতিক্রম। আবার মনে করবেন না উপহার দেওয়া মানে ও সবাইকে চার লাখ টাকার রোলেক্স দিচ্ছে বা পাঁচ কোটির হিরের সেট দিচ্ছে। ও লোক বুঝে উপহার দেয়। হয়তো ক্যামেরাম্যানের সহকারীকে দেখল খুব ভাল কাজ করছে। একদিন সেই ছেলেটাকে ডেকে ফোটোগ্রাফির একটা বই দিয়ে দিল। কোথায় যে ও সময় পায় আমি জানি না। কখন কী কেনে তাও জানি না। শুধু এটা জানি ইন্ডাস্ট্রিতে এমন বিগ হার্টেড আর কেউ নেই।

অ্যাপল স্টোরে পাঁচ ঘণ্টা
আজ সিনেমা বানানোর সময় সৃষ্টিশীলতার দিক দিয়ে আপনাকে যে রকম শক্তিশালী হতে হবে, তেমনই আপনাকে টেকনোলজির বিষয়েও সব জানতে হবে।
শুধু সিনেমা কেন, আজ আমাদের জীবনে প্রযুক্তির যে প্রভাব, তাতে সাম্প্রতিকতম প্রযুক্তিগত কলাকৌশল সম্পর্কে আপনার জ্ঞান না থাকলে আপনি পিছিয়ে পড়তে বাধ্য।
যে মানুষটা পিছিয়ে পড়তে পারে না, সেই মানুষটার নাম শাহরুখ খান।
একবার মনে আছে ওর সঙ্গে আমি নিউ ইয়র্কে অ্যাপল স্টোরে গিয়েছি। প্রথমে ভেবেছিলাম দশ মিনিট থেকেই আমরা বেরিয়ে যাব। ওহ্ মাই গড! দশ মিনিট? ওই দোকান থেকে বেরিয়েছিলাম পাঁচ ঘণ্টা পর। ওদের ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে দেখি নিজে ভাব জমিয়ে নতুন প্রোডাক্টস নিয়ে কথা বলেই চলেছে। ওদের ইনপুটস দিচ্ছে। কার না কার সঙ্গে ফোনে কথা বলছে ওদের হেডকোয়ার্টার্সে। এটুকু বুঝেছিলাম সে দিন, টেকনোলজি নিয়ে শাহরুখ খানকে কেউ হারাতে পারবে না। হি ইজ ব্রিলিয়ান্ট।
তবে এর একটা মজার দিকও আছে। ওর বাড়িতে কোনও পার্টি হলে আপনি কিন্তু প্রায় নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন আপনি সারা সন্ধে গানই শুনতে পাবেন না।
কেন? বলছি আপনাদের। কয়েক বছর আগেও ওর বাড়িতে একটা জুকবক্স ছিল। পার্টি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শাহরুখ ঘোষণা করে দিত জুকবক্সে নতুন স্পিকার লাগিয়েছে। স্পিকারগুলোর ফ্রিকোয়েন্সি আবার এমন ভাবে ম্যাচ করা যে টিভির রিমোট দিয়েই সেটার আওয়াজ কমানো-বাড়ানো যায়। শুনে হয়তো ভাবছেন দুর্দান্ত কিছু একটা হয়েছে। আসলে কিন্তু তা নয়। হচ্ছে পুরো উল্টো। সারা সন্ধে কেটে যাবে তবুও দেখবেন ফ্রিকোয়েন্সি ম্যাচ করবে না। আর একবারও পার্টিতে এমন হয়েছিল। আমাদের বলেছিল ও একটা ৬০ ইঞ্চির টিভি কিনেছে, যেখানে ও ইউটিউব ভিডিয়ো দেখে। আমরা প্রায় তিন ঘণ্টা ছিলাম, কিন্তু শাহরুখের টিভিতে ইউটিউব আর চলল না।
এগুলো মজার ঘটনা ঠিকই, কিন্তু এটুকু আমরা বুঝি যে টেকনোলজির প্রতি আগ্রহ ওকে কতটা বাড়তি ‘কিক’ দেয়। আজ যে পর্যায়ের কম্পিউটার গ্রাফিক্স সিনেমায় এসেছে, সেখানে ও প্রযুক্তিতে এতটা এগিয়ে বলেই রেড চিলিজের ভিএফএক্স কোম্পানিটা শুরু করতে পেরেছে। প্রযুক্তি নিয়ে এই আগ্রহটা একই সঙ্গে আকর্ষক আর অনন্য লাগে আমার।

অসাধারণ রিডিং হ্যাবিট
শাহরুখের ব্যস্ততা কাছ থেকে না-দেখলে বোঝা যাবে না। কিন্তু এত ব্যস্ততার মধ্যেও দেখেছি বই পড়ার অভ্যাসটা ছাড়েনি ও। ম্যানেজমেন্টের বই হোক, কী কারও আত্মজীবনী, কী কোনও কবিতার বই শাহরুখের বই চাই-ই-চাই। লম্বা ফ্লাইটে ওর সঙ্গে আমেরিকা গেছি। ঘুমানোর ফাঁকে ফাঁকে দেখেছি ও বই পড়ছে। আজকাল দেখছি ওর এই বই পড়ার অভ্যাসটা আরিয়ান আর সুহানার মধ্যেও ঢুকিয়ে দিয়েছে। ওরাও বাবার মতো বই পড়ে সারাক্ষণ। এই একটা জায়গায় ওর সঙ্গে আমার ভীষণ মিল। আমিও বইয়ের পোকা। এত বই পড়ে বলেই ওর সাধারণ জ্ঞান সাঙ্ঘাতিক। ওর সঙ্গে ‘ট্রিভিয়াল পারসুইট’য়ের মতো গেমস খেলার সময় সেটা বুঝতে পারি।
এই পড়াশোনা, এমন সাধারণ জ্ঞান আর কোনও অভিনেতার আছে কি না আমার জানা নেই। এই ফাঁকে একটা কথা বলে রাখি, শাহরুখের সঙ্গে কাজ করতে হলে আড়াই ঘণ্টা হাতে রেখে চলতে হবে। আপনাকে ধরেই নিতে হবে ও আড়াই ঘণ্টা পরে পৌঁছবে। আমি এত দিন ওর সঙ্গে কাজ করছি, কিন্তু শ্যুটিংয়ে, দিনের প্রথম তিনটে দৃশ্যে কখনও ওকে রাখিনি। ও বেচারা করবেই বা কী! শুতেই তো যায় ভোর পাঁচটায়। এ ব্যাপারে আপনার কিচ্ছুটি করার নেই। এটা মেনে নিতেই হবে।

উইজডম ট্রি
আমি কেন, ওর কাছাকাছি যারাই পৌঁছনোর সুযোগ পেয়েছে তারাই ওর জ্ঞানের, ওর উইজডমের কথা বলবে।
অনেক সময় এমন হয়েছে ও আমাকে একটা কথা বলেছে। কিন্তু আমি সেটা মন দিয়ে শুনিনি। ছ’মাস পরে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছিল, যাতে আমি বুঝেছি ও এটাই আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করছিল।
ও যখন এই জ্ঞানগুলো দেয়, আমরা সবাই মজা করে ওর আড়ালে বলি, “জ্ঞানগুরু চালু হো গয়া।” ও নিজেও জানে আমরা ওকে ‘জ্ঞানগুরু’ কী ‘উইজডম ট্রি’ বলি। আমাদের গালাগালিও দেয় সেটার জন্য। আর এই জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতাগুলো কিন্তু দু’-তিন ঘণ্টাও চলতে পারে।
কিন্তু আমি একা নই। অনেক মানুষের জীবনই বদলে দিয়েছে ওর উইজডম।

শাহরুখের অপছন্দ
• সারা দিনের জন্য যদি আপনি শাহরুখকে রাগাতে চান, তা হলে ওকে ভুল মাপের জিন্স আর টি-শার্ট দিন। ব্যস্, আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন শাহরুখ সারা দিন বিরক্ত থাকবে আপনার ওপর
• ওর জুতোর সঙ্গে মোজা ম্যাচ না-করলেও একই কাণ্ড হবে! ও অসম্ভব বিরক্ত হয় এই দু’টো জিনিসে



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.