দুর্নীতি মামলায় একাধিক বার জেরা করা হয়েছে তাঁকে। জেরায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও পেয়েছে পুলিশ। এ বার শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এসজেডিএ) ৬০ কোটি টাকার দুর্নীতি মামলায় মালদহের জেলাশাসক (ডিএম) গোদালা কিরণ কুমারকে গ্রেফতারের অনুমতি চাইলেন শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার কারলিয়াপ্পন জয়রামন। যে সময় ওই দুর্নীতি হয়েছিল, তখন কিরণ কুমার ওই সংস্থার চিফ এগ্জিকিউটিভ অফিসার (সিইও) ছিলেন।
পঞ্চায়েত ভোটের আগেই রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে ওই আইএএস অফিসারকে গ্রেফতারের অনুমতি চেয়েছিলেন জয়রামন। ভোটের জন্য এই প্রক্রিয়া এত দিন বন্ধ ছিল। তা শেষ হতেই নড়েচড়ে বসেছে মহাকরণ। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর অফিস সবই জানে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেই পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে।”
দুর্নীতি মামলায় তদন্ত কত দূর এগিয়েছে, তাতে কী কী তথ্য মিলেছে ডিজিকে লেখা চিঠিতে সে সবও সবিস্তার জানিয়েছেন জয়রামন। তিনি লিখেছেন, কাজের দরপত্র ডাকা, বরাত দেওয়া ও ঠিকাদারি সংস্থার বিল মেটানোর ক্ষেত্রে কিরণ কুমারের সক্রিয় ভূমিকা অনেকটাই স্পষ্ট। এ নিয়ে শিলিগুড়ির মানুষের মনে যথেষ্ট ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এমনকী, সিবিআই তদন্তেরও দাবি উঠেছে। অভিযুক্তদের জেরা করার ক্ষেত্রে দেরি হলে তা তদন্তকারী সংস্থার সুনাম নষ্ট করবে। তার আঁচ পড়বে সরকারের উপরেও। |
দুর্নীতি মামলায় এসজেডিএ-র অপসারিত চেয়ারম্যান রুদ্রনাথ ভট্টাচার্যের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। ডিজিকে লেখা চিঠিতে সে কথাও জানিয়েছেন জয়রামন। শিলিগুড়ির ওই তৃণমূল বিধায়ককে এর মধ্যেই এক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। এর বাইরেও জেরা করা হয়েছে এসজেডিএ বোর্ড সদস্য, তথা জলপাইগুড়ি জেলা তৃণমূলের সভাপতি চন্দন ভৌমিক এবং শিলিগুড়ি পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর রঞ্জন শীলশর্মাকে (যিনি থুতুকাণ্ডেও অভিযুক্ত)। ওই মামলায় ডেকে পাঠানো হয়েছে দার্জিলিং জেলা কংগ্রেস সভাপতি তথা মাটিগাড়া-নকশালবাড়ির বিধায়ক এবং এসজেডিএ সদস্য শঙ্কর মালাকারকেও। রাজ্য পুলিশের এক কর্তা বলেন, “তদন্তের স্বার্থে আরও কিছু নেতাকে জেরা করার সম্ভাবনা এখনই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।”
এই পরিস্থিতিতে শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনারের চিঠি পাওয়ার পরে নড়েচড়ে বসেছে রাজ্য প্রশাসনও। জয়রামন চিঠিতে জানিয়েছেন, গত বছরের ২৭ অগস্ট থেকে ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে কলকাতার একটি ঠিকাদারি সংস্থাকে মহানন্দা অ্যাকশন প্ল্যানের অধীনে নিকাশি ব্যবস্থা তৈরি, বাগডোগরা, মালবাজার ও ময়নাগুড়ি শ্মশানে বৈদ্যুতিক চুল্লি বসানোর বরাত দিয়েছিল এসজেডিএ। এই বরাতগুলির দেওয়া হয়েছিল মাত্র সাত দিনের নোটিসে। তদন্তে নেমে পুলিশ জেনেছে, সংস্থাটি একাই ১২০ কোটি ৮০ লক্ষ টাকার বরাত পেয়েছিল। এমনকী, মালপত্র সরবরাহ করার আগেই তাদের ৫৩ কোটি ৮৩ লক্ষ টাকার বিল মিটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নথিপত্র খতিয়ে দেখে তদন্তকারী অফিসারদের মনে হয়েছে, এসজেডিএ-র সিইও কিরণ কুমার ও কয়েক জন ইঞ্জিনিয়ার জেনেবুঝেই কাজের আগে টাকা পাইয়ে দিয়েছিলেন ওই ঠিকাদারি সংস্থাকে।
ঘটনা হল, মাস ছয়েক আগে এসজেডিএ-তে কাজের নামে লুঠপাট চলছে বলে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবের কাছে নানা মহল থেকে অভিযোগ আসে। বিষয়টি জানতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এর মধ্যেই প্রশাসনের প্রাথমিক রিপোর্ট তাঁর হাতে পৌঁছয়। ঘটনাচক্রে তখন মুখ্যমন্ত্রী শিলিগুড়িতেই ছিলেন। সরকারি সূত্রের খবর, এ কাজে তিনি যে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ, তা এসজেডিএ-এর চেয়ারম্যান রুদ্রনাথবাবুকে ডেকে বাগডোগরা বিমানবন্দরেই বুঝিয়ে দেন মমতা। সে দিনই কলকাতায় ফেরেন মুখ্যমন্ত্রী। একই বিমানে আসেন রুদ্রনাথবাবুও। কিন্তু তিনি কলকাতায় পৌঁছনোর আগেই তাঁকে সরিয়ে এসজেডিএ-এর দায়িত্ব দেওয়া হয় গৌতমবাবুকে। কেড়ে নেওয়া হয় রুদ্রনাথবাবুর সরকারি গাড়ি। এর পরেই এসজেডিএ-র তরফে এফআইআর করেন ওই সংস্থার বর্তমান সিইও শরদ দ্বিবেদী। ওই এফআইআরের ভিত্তিতেই চারটি মামলা রুজু করেছে পুলিশ। |
ওই সব মামলার প্রেক্ষিতেই এ পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে তিন জন সরকারি অফিসার। তাঁরা হলেন এসজেডিএ-র তৎকালীন এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার মৃগাঙ্কমৌলি সরকার, অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার সপ্তর্ষি পাল এবং সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার প্রবীণ কুমার। বাকিরা পেশায় ঠিকাদার। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই বৈদ্যুতিক চুল্লি বসানো ও নিকাশি নালার টাকা নয়ছয়ে যুক্ত বলে সন্দেহ। এক জনকে ধরা হয়েছে সিসিটিভি বসানোয় কারচুপির অভিযোগে। ধৃতদের একাংশ যে ভাবে একাধিক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে নিত্য ওঠাবসা করতেন, তা চোখে পড়েছে গোটা শিলিগুড়ির।
এঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগগুলি কী কী? তার কয়েকটি হল
• তিনটি শ্মশানে বৈদ্যুতিক চুল্লি তৈরির জন্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা খরচ দেখানো হলেও কাজ সে ভাবে এগোয়নি।
•l ৪০ কোটি টাকার নিকাশি ব্যবস্থা তৈরির জন্য ঠিকাদার সংস্থাকে সব টাকা দেওয়া হলেও কাজ হয়নি বললেই চলে। • শিলিগুড়ি শহর জুড়ে ন’কোটি টাকার সিসিটিভি বসানোর কথা থাকলেও বাস্তবে নিম্ন মানের ক্যামেরা বসিয়ে প্রায় পুরো টাকাই আত্মসাৎ করা হয়েছে। • জোড়াপানি নদী খাতের গভীরতা বাড়াতে ন’কোটি টাকার কাজ হয়েছে বলে কাগজেকলমে দেখানো হলেও বাস্তবে ৮০ লক্ষ টাকার বেশি কাজ হয়নি।
কিন্তু দরপত্র তো ডাকা হয়েছিল অন লাইনে? সেখানে কারচুপির সুযোগ কোথায়? পুলিশি তদন্ত বলছে, যে ওয়েবসাইট-এর মাধ্যমে দরপত্র জমা পড়েছিল, সেটির দেখভালের ভার ‘ইন্ডিয়ান টেলিফোন ইন্ডাস্ট্রি’ নামে একটি সংস্থার উপরে থাকলেও ওই সাইটে ঢোকার ডঙ্গলটি একমাত্র কিরণ কুমারই জানতেন। সেই ডঙ্গলটি ব্যবহার করেই দরপত্রে কে কত দাম হেঁকেছে, তা অনায়াসেই জেনে যেতেন তিনি। তার পরে এক শ্রেণির ইঞ্জিনিয়ারদের সাহায্যে বরাত-মূল্যের হেরফের ঘটিয়ে পছন্দের ঠিকাদারি সংস্থাকেই একচেটিয়া কাজ দেওয়া হয়েছিল বলে জেনেছে পুলিশ।
পুলিশের আরও বক্তব্য, রাজ্য বা কেন্দ্রীয় প্রকল্পের কোনও টাকা ওই খাতে ব্যয় করা হয়নি। এসজেডিএ-র যে নিজস্ব তহবিল আছে, তারই ‘ফিক্সড ডিপোজিট’ ভাঙিয়ে ঠিকাদারদের কোটি কোটি টাকা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজ্য প্রশাসনকে অন্ধকারে রাখতেই ওই কৌশল নেওয়া হয়েছিল বলে মনে করছেন একাধিক পুলিশকর্তা। |