দেবলীনা রায়। কলকাতার লেকটাউনে বাড়ি। ভুগোলে অনার্স পড়বে বলে শহরের প্রেসিডেন্সি, গোখেল আর আশুতোষ কলেজে ফর্ম তুলেছেন। ভর্তি নিয়ে এখনও দোনামনায়।
লক্ষ্মীমণি সিংহ সর্দার। পশ্চিম মেদিনীপুরের বাঁশপাহাড়িতে বাড়ি। কাছেপিছে খালি শিলদা কলেজ। কাছে বলতে ৩৫-৩৬ কিলোমিটার। বাসে যোগাযোগও ভাল নয়। অতটা পথ উজিয়ে কলেজে যাবেন কী ভাবে তা নিয়েই এখন চিন্তা লক্ষ্মীর।
কলকাতা আর জঙ্গলমহলের এই দুই বিপরীত ছবিই স্পষ্ট করে দেয় রাজ্যে উচ্চশিক্ষার বেহাল পরিকাঠামোকে। সম্প্রতি রাজ্য সরকার একটি বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে কলেজ সংক্রান্ত সমীক্ষা করিয়েছে। তাতেও চরম এই বৈপরীত্যই সামনে এসেছে। কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় যেখানে কলেজের সংখ্যা একশোর কাছে, সেখানে রাজ্যের অনেক জায়গায় ত্রিশ-চল্লিশ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে কোনও কলেজ নেই। বাঁশপাহাড়ির লক্ষ্মী তবু কষ্ট করে হলেও কলেজে যাওয়ার কথা ভাবছেন। তাঁর সহপাঠীরা অনেকেই কিন্তু পড়াশোনায় ইতি টেনেছেন শুধুমাত্র কাছেপিঠে কলেজ না থাকার কারণে।
পশ্চিম মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রাম মহকুমার ৮টি ব্লকের মধ্যে ১৭৬টি গ্রাম রয়েছে জঙ্গল লাগোয় দুর্গম এলাকায়। শালবনি, বেলিয়াবেড়া, নয়াগ্রাম ও লালগড় ব্লকে কোনও কলেজ নেই। নয়াগ্রামের ছেলে-মেয়েরা বাসে চেপে ৩৫ কিমি দূরে গোপীবল্লভপুর কলেজে পড়তে যান। কিন্তু একটা কলেজে আর কত জনের জায়গা হবে? ফলে আরও দূরে বেলদা, দাঁতন বা মেদিনীপুরে কলেজে যেতে হয় তাঁদের। বর্ষাকালে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ায়। সুবর্ণরেখায় জল বাড়লে নৌকো করে নদী পেরিয়ে ভসরাঘাটে গিয়ে বেলদা, দাঁতন ও মেদিনীপুর রুটের বাস ধরতে হয়। ছেলেরা তবুও কষ্ট করে যাতায়াত করতে পারে। মেয়েদের পক্ষে একেবারেই সম্ভব হয় না। নয়াগ্রামের একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিকাশকুমার মণ্ডল বলেন, “এলাকায় কলেজ না থাকায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম উচ্চতর শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তবে শালবনি, নয়াগ্রাম ও লালগড়ে কলেজ হচ্ছে বলে শুনছি। এটাই আশার আলো।”
বেসরকারি ওই সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী অবশ্য সবচেয়ে খারাপ অবস্থা উত্তর দিনাজপুরের। এই জেলার হেমতাবাদ, গোয়ালপোখর ১ ও ২ ও চোপড়া ব্লকে কোনও কলেজ নেই। গোয়ালপোখর ২ ব্লকের চাকুলিয়ার বাসিন্দা ইংরেজি অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মামণি ঝা। কাছেপিঠে কলেজ না থাকায় প্রতিদিন ৩০ কিলোমিটার দূরে ইসলামপুর কলেজে তাঁকে যেতে হয়। গাড়ি না পেয়ে বা যানজটের জন্য প্রায়শই কলেজে যাওয়া হয় না। মালদহের মানিকচক, হবিবপুর ও কালিয়াচক ২ নম্বর ব্লকে কলেজ নেই। ফলে মালদহ কলেজ ও মালদহ মহিলা মহাবিদ্যালয়ের উপর ছাত্রছাত্রীদের চাপ বাড়ছে। জলপাইগুড়ি জেলার ১৩টি ব্লকে কলেজের সংখ্যা ১৫ হলেও সেখানেও বৈষম্য। নাগরাকাটা এবং মেটিলি ব্লকে কোনও কলেজ না থাকায় ছাত্রছাত্রীদের যেতে হয় মালবাজার কলেজে। কলেজ শিক্ষকদের সংগঠন ওয়েবকুটার জলপাইগুড়ি জেলার নির্বাহী কমিটির সদস্য রূপণ সরকার বলেন, “অন্ততপক্ষে কলেজ পড়ুয়াদের যাতায়াতের জন্য কিছু বাস তো দিতে পারে সরকার।”
দক্ষিণবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদ জেলাতেও কলেজের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এর মধ্যে সুন্দরবন এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় পড়ুয়াদের সবচেয়ে বেশি সমস্যার মুখে পড়তে হয়। উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালি ১ ও ২ ব্লক মিলিয়ে মোট ৯টি দ্বীপ রয়েছে। তার মধ্যে কালিনগর দ্বীপে একটি মাত্র কলেজ আছে। অন্য জায়গাগুলি থেকে নৌকা বা ভুটভুটি চেপে কলেজে আসেন পড়ুয়ারা। সব-সময় নৌকা পাওয়া যায় না। প্রাকৃতিক দুর্যোগের দিনগুলিতে সে প্রশ্নই ওঠে না। স্বাভাবিক ভাবেই উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকাগুলি।
পশ্চিমবঙ্গের উচ্চ শিক্ষা আধিকারিক দীপক কুমার মণ্ডল আশ্বাস দেন, “রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় নতুন কলেজ তৈরির প্রক্রিয়া চলছে।”
প্রক্রিয়া আর তার ফলদু’টো নিয়েই সন্দিহান যুবসমাজ।
|