বন দফতরের আশঙ্কাই সত্যি হল। শেষ পর্যন্ত গড়পঞ্চকোট পাহাড়েই মন বসে গেল দাঁতালের। পাহাড় চুড়ো থেকে তাকে নড়াতে না পেরে আপাতত রণে ভঙ্গ দিলেন বনকর্মীরা। ফেরত পাঠানো হল বিষ্ণুপুর থেকে হাতি তাড়াতে আসা হুলাপার্টির কর্মীদেরও।
টানা এক সপ্তাহ ধরে হাতিটি পাহাড়ের উপর-নীচে ওঠানামা করতে থাকায় তার পিছু নেওয়া বনকর্মীরা ক্নান্ত যেমন হয়েছেন, তেমনই বন দফতরের খরচের বহরও বেড়ে গিয়েছে। এমনই দাবি করে বন দফতর আপাতত হাতি তাড়ানো অভিযানে রাশ টানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কংসাবতী (উত্তর) বন বিভাগের ডিএফও সোমা দাস বুধবার বলেন, “ওই এলাকায় হাতির আনাগোনা কার্যত এত দিন ছিল না। তাই স্থানীয় বাসিন্দারা হাতির আচরণের সঙ্গে পরিচিত নন। সে কারণে আমরা উদ্বেগে রয়েছি। হাতিটিকে উত্ত্যক্ত না করার জন্য এলাকায় প্রচার শুরু করা হয়েছে।”
এক সপ্তাহ আগে বাঁকুড়া থেকে সাঁতুড়ি ও রঘুনাথপুর হয়ে নিতুড়িয়ার গড়পঞ্চকোট পাহাড়ে চলে আসে পূর্ণবয়স্ক ওই দাঁতাল। হুলাপার্টির তাড়া খেয়ে বারেবারেই হাতিটি উঠেছে পঞ্চকোট পাহাড়ের উপরে। বুধবার সকাল থেকে সে রয়েছে পাহাড়ের চুড়োর কাছাকাছি, প্রায় ১৫০০ ফুট উপরে। সোমাদেবীর কথায়, “বর্ষাকালে পাহাড়ের উপরে খাবার ও জল পেয়ে হাতিটি সেখানেই থাকতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে।” কিন্তু, বন দফতরের কাছে সমস্যা গড় পঞ্চকোট পাহাড় ছাড়া ওই এলাকায় ঘন জঙ্গল নেই। পাহাড়ের উপরে খাবার ও জলে টান পড়লেই দাঁতালটি নীচে নেমে খাবারের সন্ধানে গ্রামে ঢুকে হামলা করতে পারে বলে আশঙ্কায় বনকর্তারা। |
হাতির হানায় ভেঙেছে স্কুলের পাঁচিলও। ছবি: শুভ্র মিত্র |
পাশাপাশি পাহাড়ের কোলেই রয়েছে বন উন্নয়ন নিগমের প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্রের কটেজগুলি। বছরভরই সেখানে পর্যটকদের আনাগোনা। এই দিকটিও ভাবাচ্ছে বন দফতরকে। ফলে, দাঁতালটিকে তাড়িয়ে বাঁকুড়ায় ফেরত পাঠানোর চেষ্টায় কসুর করেননি বনকর্মীরা। কিন্তু, হুলাপার্টিকে টানা রেখে দেওয়ার মতো অর্থ কোথায়? হাতি উপদ্রুত এলাকা বলে চিহ্নিত নয় কংসাবতী (উত্তর) ডিভিশন। গত পাঁচ-ছয় বছরে মাত্র চার-পাঁচ বার বাঁকুড়া থেকে হাতি ঢুকেছিল এই ডিভিশন এলাকায়। বন দফতর সূত্রের খবর, পুরুলিয়া জেলার অন্য ডিভিশনগুলি হাতি উপদ্রুত হিসাবে চিহ্নিত হওয়ায় সেখানে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ, হাতি সংরক্ষণ বা এলিফ্যান্ট প্রজেক্টের টাকা থেকে হাতি তাড়ানোর জন্য অর্থের সংস্থান মেলে। কিন্তু ওই অর্থ কংসবাতী উত্তর ডিভিশনের ক্ষেত্রে মিলবে না। দফতরের এক কর্তা বলেন, “হুলাপাটি নিয়ে হাতি তাড়াতে দৈনিক খরচ গড়ে ১০-১২ হাজার টাকা। রঘুনাথপুরের ক্ষেত্রে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে হাতি তাড়ানোর কাজে খরচের পরিমাণ ৬০-৭০ হাজার টাকার মতো। কিন্তু, এই ডিভিশনের হাতে হাতি তাড়ানোর অত টাকা নেই।”
দফতর সূত্রে জানা যাচ্ছে, অন্য ডিভিশনগুলির মতো হাতি সংক্রান্ত কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের প্রকল্পগুলির আওতায় না থাকায় রঘুনাথপুরের ক্ষেত্রে টাকা খরচ করতে হবে পরিকল্পনা বহির্ভূত তহবিল থেকে। বছরে ১৫-২০ লক্ষ টাকা ওই তহবিলে পায় প্রতি ডিভিশন। কিন্তু, সেই টাকায় অন্যান্য বহু কাজ করতে হয় তাদের। হাতি তাড়ানোয় বাড়তি খরচ হওয়ায় ইতিমধ্যেই টান পড়ছে ওই তহবিলে। ডিএফও বলেছেন, “আর্থিক সমস্যা মেটাতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করব।” আর আপাতত বন দফতরের রক্তচাপ বাড়িয়ে গড় পঞ্চকোট পাহাড়েই বহাল তবিয়তে থাকবে গজরাজ। |
তাণ্ডব বিষ্ণুপুরের গ্রামেও
নিজস্ব সংবাদদাতা • বিষ্ণুপুর |
পিয়ারডোবা স্টেশন লাগোয়া দু’টি দোকানে হামলা চালিয়ে ধান, গম খেয়ে গেল একটি দাঁতাল। মঙ্গলবার গভীর রাতে বাঁকাদহ রেঞ্জের জঙ্গল থেকে এসে হাতিটি একটি ধান ও গম ভাঙার কলে ভাঙচুর করে। লোহার পাত ও কাঠের তৈরি দরজা ভেঙে হাতিটি দোকানের ভিতরে ঢুকে ধান ও গম খেয়ে ছড়িয়ে নষ্ট করে। বস্তা ছিঁড়ে আটা ও চাল খেয়ে যায়। মিলের পাশের একটি সব্জি দোকানও তছনছ করে হাতিটি। ক্ষতিগ্রস্ত হাস্কিং মিলের মালিক সুমিত নায়ক বলেন, “হাতিটি ঢুকতেই এলাকার মানুষ জেগে যান। কিন্তু বিশাল চেহারার দাঁতালের ভয়ে কেউ কাছেধারে ঘেঁষার সাহস করেনি। ফলে নির্বিচারে ভাঙচুর চালিয়ে পেট ভরিয়ে জঙ্গলে ঢুকে যায় হাতিটি।” বন কর্মীদের ডেকেও সাড়া মেলেনি বলে তাঁর অভিযোগ। সব্জি দোকানের মালিক রবিয়াল মল্লিকও বলেন, “দোকান ভেঙে সব্জি খেয়ে প্রচুর টাকার ক্ষতি করল হাতি।” গ্রামবাসী চিত্তরঞ্জন নায়কের ক্ষোভ, “কয়েক দিন আগেই একটা হাতি এলাকায় ঢুকে হাইস্কুলের সীমানা প্রাচীর ভেঙে দিয়ে গিয়েছে। আমরা ভয়ে আছি। তবু বন দফতরের হেলদোল নেই।” সম্প্রতি পিয়ারডোবা লাগোয়া দুন্দুড় গ্রামে এক মহিলা হাতির তাড়া খেয়ে জখম হয়েছেন। তিনি এখনও বিষ্ণুপুর হাসপাতালে ভর্তি। বাঁকাদহের রেঞ্জ অফিসার বিজয় চক্রবর্তী বলেন, “কোনও দলছুট হাতি উপদ্রব চালাচ্ছে। আমরা হাতিটাকে নজরে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছি। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের আবেদন করতে বলা হয়েছে।” |