আসন একটাই। দাবিদার অনেক। কে বসবেন সভাধিপতির আসনে? এই প্রশ্নই ঘুরছে বাঁকুড়া জেলায় তৃণমূলের অন্দরে, চায়ের আড্ডা থেকে অফিসে-ক্যান্টিনে।
এ দিকে সভাধিপতির নাম ঘোষণার দিন যত এগিয়ে আসছে, জেলার তৃণমূল নেতাদের মধ্যে উত্তেজনার পারদ ততই চড়ছে। বসে নেই তৃণমূলের জেলা পরিষদের জয়ী প্রার্থীরাও। তাঁদের অনেকেই নির্বাচনের ফল ঘোষণার রেশ কাটতেই জেলা ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে ঘাঁটি গেড়েছেন। সকাল-বিকেল তাঁরা দলের এ নেতা, ও নেতার সঙ্গে ঘনঘন সাক্ষাৎ করছেন। সভাধিপতির আসন নিয়ে যে টানাপোড়েনের সূচনা হয়েছে, তার জল কতদূর গড়ায় তা দেখতে মুখিয়ে রয়েছেন জেলাবাসীও।
তৃণমূল সূত্রের খবর, সভাধিপতির দৌড়ে প্রাথমিকভাবে যাঁরা এগিয়ে রয়েছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন জেলা তৃণমূলের কো-চেয়ারম্যান অরূপ চক্রবর্তী। জেলা তৃণমূলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক শ্যামল সরকারও আসরে নেমে পড়েছেন। দৌড়ে রয়েছেন রানিবাঁধের তৃণমূল নেত্রী তথা জেলা পরিষদের প্রাক্তন অধ্যক্ষ (বিরোধী দলনেত্রী) বিভাবতী টুডু ও তৃণমূলের কোতুলপুর ব্লকের সভাপতি প্রবীর গরাইও।
জেলা প্রশাসন ও দলের মধ্যে গুঞ্জন উঠেছে, সহ-সভাধিপতির পদটি তফশিলি জাতি-উপজাতির জন্য সংরক্ষিত হওয়ায় ওই পদে বসতে পারেন বিভাবতীদেবী। যার জেরে সভাধিপতির লড়াই থেকে কার্যত তিনি সরে থাকছেন বলেই তৃণমূলের একাংশের ধারনা। বিভাবতীদেবী অবশ্য পদ নিয়ে মাথা ঘামান না বলে প্রকাশ্যে জানাচ্ছেন। তাঁর দাবি, “আমি পদের আশা করি না। দল যাকে যেখানে বসাবে তাকে সেখানেই বসতে হবে। জিতে দিদির হাত শক্ত করতে পেরেছি, এতেই আমি সন্তুষ্ট।”
বিভাবতীদেবী সহ-সভাধিপতি হলে, সভাধিপতির দৌড়ে শ্যামলবাবুর পাল্লা হালকা হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন তৃণমূল নেতাদের একাংশ। তাঁদের ব্যাখ্যা, বিভাবতীদেবী ও শ্যামলবাবু দু’জনেই খাতড়া মহকুমার বাসিন্দা। সে ক্ষেত্রে সভাধিপতি ও সহ-সভাধিপতি দু’টি পদই একই মহকুমার হয়ে যাবে। জেলার অন্য দুই মহকুমাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে বলে বিতর্কও বাঁধতে পারে। শ্যামলবাবু খাতড়া মহকুমার জনপ্রিয় তৃণমূল নেতাদের মধ্যে অন্যতম। জঙ্গলমহলে তৃণমূলের জয়ের পিছনেও তাঁর বড়সড় অবদান রয়েছে। তাই তাঁর জয়কে কেন্দ্র করে জেলা তৃণমূলের একটা অংশ তাঁকেই সভাধিপতি হিসেবে দেখার আশায় বুক বেঁধেছেন। শ্যামলবাবু অবশ্য কোনও বিতর্কেই যেতে নারাজ। তিনিও বলছেন, “দলই শেষ কথা। আমি পদের কথা ভাবিনা।”
সভাধিপতির দৌড়ে অন্যদের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিচ্ছেন তৃণমূলের বিতর্কিত নেতা প্রবীর গরাই। তাঁর স্ত্রী প্রাক্তন মাওবাদী নেত্রী সুচিত্রা মাহাতো মহাকরণে আত্মসমর্পণ করার পরেই প্রবীরবাবুর নাম জানা যায়। জনগণের কমিটির এই প্রাক্তন নেতাই এরপরে তৃণমূলে যোগ দেন এবং সরাসরি ব্লক সভাপতির পদ পেয়ে যান। এ নিয়ে জেলায় বিতর্ক কম হয়নি। কোতুলপুরে দীর্ঘদিন তৃণমূল করে আসা নেতা-কর্মীদের অনেকেই প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করে দলের রোষানলে পড়েন। জেলা পরিষদের নির্বাচনে তাঁর গোঁজ হিসেবে দলেরই এক বর্ষীয়ান নেতা নির্দল হিসেবে লড়াই করেন। তা সত্ত্বেও প্রবীরবাবু জেলা পরিষদের জয়ী প্রার্থীদের মধ্যে সব চেয়ে বেশি ব্যবধান নিয়ে জয়ী হয়েছেন। এখন মৃদু হেসে প্রবীরবাবু নিজেই বলছেন, “সভাধিপতি হিসেবে অনেকের সঙ্গে আমার নামটাও উঠছে বলে কানে এসেছে। দল আমাকে যা দায়িত্ব দেবে আমি তাই পালন করব।” যদিও তৃণমূলের একাংশ অবশ্য সভাধিপতি হিসেবে তাঁকে দেখতে চাইছেন না। তাঁদের কথায়, প্রবীরবাবুর অতীতকে একেবারেই ভুলে যাওয়া ঠিক নয়। মাও ঘনিষ্ঠ জনগণের কমিটির ওই নেতাকে প্রশাসনের শীর্ষপদে বসালে মানুষের সমর্থন থাকবে কী না তা নিয়ে দলের ভাবা উচিত।
জেলা সভাধিপতির দৌড়ে প্রথম সারিতেই রয়েছেন প্রয়াত তৃণমূল নেতা কাশীনাথ মিশ্রের একদা সহচর আইনজীবী অরূপ চক্রবর্তী। দলের কো-চেয়ারম্যান হওয়ায় তিনি জেলার মধ্যে অন্যতম হেভিওয়েট প্রার্থী। তাই অরূপবাবুই সভাধিপতি হতে যাচ্ছেন বলে ভোটে প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই দলে গুঞ্জন উঠেছিল। সভাধিপতি ঘোষণার দিন যত এগিয়ে আসছে গুঞ্জন আরও তীব্র হচ্ছে দলের অন্দরে। তৃণমূল নেতাদের একাংশের কথায়, অন্যান্য প্রার্থীদের চেয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠিতে তিনি এগিয়ে। দীর্ঘদিনের তৃণমূল নেতা হিসেবে তাঁর পরিচিতিও রাজ্যজুড়ে রয়েছে। যদিও অরূপবাবু বলছেন, “ক্ষমতা পাওয়ার লোভ আমার নেই। দলের সিদ্ধান্তই মেনে নেব।” আবার দলের একাংশের মতে, সে ভাবে প্রথমসারির নেতা নয় অথচ শিক্ষাগত উচ্চ যোগ্যতা সম্পন্ন অন্য কোনও জয়ী প্রার্থীকেও দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সভাধিপতি হিসেবে বেছে নিতে পারেন। আপাতত এমনই নানা সম্ভাবনা নিয়ে
সভাধিপতির প্রশ্নে জেলাবাসীর কৌতূহল যত বাড়ছে, তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব মুখে ততই কুলুপ আঁটছেন। তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী বলেন, সভাধিপতি কে হবেন তা ঠিক সময়েই জানা যাবে। এখন কিছুই বলা সম্ভব নয়।” একই বক্তব্য রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূলের জেলা চেয়ারম্যান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়েরও। তৃণমূলের বাঁকুড়া জেলা সভাপতি অরূপ খাঁ বলেন, “আর ক’টা দিন সবাই অপেক্ষা করুন। আশা করছি দিন দশেকের মধ্যেই বাঁকুড়া জেলা সভাধিপতির নাম দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ঘোষণা করবে।” |