জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে হাতি। তটস্থ গ্রামবাসীরা দৌড়োচ্ছেন। পানীয় জলের জন্য বাঁধ দিয়ে বৃষ্টির জল ধরে রাখার চেষ্টা করছেন মানুষজন। বাঁচার জন্য প্রতিদিনের লড়াইয়ের এমনই নানা ছবি রঙ-পেন্সিল দিয়ে কাগজে আঁকছিল খুদে আদিবাসী বালকবালিকারা। নিছক গ্রাম্য পরিবেশ কিংবা নিঝুম নিসর্গ প্রকৃতির ছবিও ওদের কেউ আঁকল। সৌজন্যে সিধো কানহো বীরসা বিশ্ববিদ্যালয় ও ন্যাশন্যাল বুক ট্রাস্ট।
ওই দুই প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে পুরুলিয়ায় শুরু হওয়া ‘সাঁওতালি ও কুড়মালি ভাষার পুরনরুজ্জীবন ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনাচক্র উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার এই আঁকার কর্মশালা হয়। জনজাতি এলাকার খুদেদের নিয়ে বিএড কলেজে কর্মশালাটি হল। অযোধ্যা পাহাড়ের বিভিন্ন গ্রাম, বান্দোয়ান, সাঁতুড়ি-সহ জেলার নানা এলাকার ৪৬ জন আদিবাসী পড়ুয়া এসেছিল এ দিনের কর্মশালায়। বেশির ভাগই তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া। শহরে এসে এমন কর্মশালায় যোগ দেওয়ার অভিজ্ঞতা তো নেই-ই, স্কুলেও অতীতে এমন কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার সংখ্যাও হাতেগোনা।
কচি হাতে বাহারি রঙ পেন্সিলে অযোধ্যা পাহাড়ের মাতকুমডির কৈলাশ মুর্মু বা ভুরসাবেড়ার রাজীব মুর্মু বা কুসুমটিকরির সুশীল টুডুর মতো খুদে শিল্পীদের ভাবনায় উঠে এসেছে চেনা পরিবেশ। এই বয়সে উপলব্ধি করা সমস্যার কথা। |
মগ্ন। পুরুলিয়ায় ছবিটি তুলেছেন সুজিত মাহাতো। |
ভুরসাবেড়ার রাজীব মুর্মু এঁকেছে জঙ্গল ছেড়ে আচমকা লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে হাতি। ইচাঘট গ্রামের চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া কার্তিক হাঁসদার সৃষ্টি নিসর্গ প্রকৃতির সঙ্গে রয়েছে জলের উৎসের অনুসন্ধান। তেমনি ভাবে কুসুমটিকরির দ্বিতীয় শ্রেণির পড়ুয়া সুশীল টুডুর ছবিতে প্রকৃতির সৌন্দর্যের মধ্যেও রয়েছে জলের অভাব। কর্মশালা শেষে রাজীবের প্রতিক্রিয়া, “আমাদের গ্রাম ও পাশের গ্রাম উসুলডুংরি, কেন্দঘুটু-সহ বিভিন্ন গ্রামে হাতি ঢুকে পড়ে। আমি সেটাই করেছি।” কার্তিক বলে, “আমাদের গ্রামে জলের বড় অভাব। ছবি আঁকতে বসে সে কথাই মনে পড়ছিল।” “জলাভাব অযোধ্যা পাহাড়ের নিত্যসঙ্গী। স্বভাবতই শিশুদের কল্পনায় সেই বিষয়টিই উঠে এসেছে”, বলছিলেন এ দিনের আলোচনাচক্রে উপস্থিত হুড়ার বাসিন্দা রাখহরি মাহাতো। আবার সাঁতুড়ির দুমদুমি গ্রামের বাসিন্দা তৃতীয় শ্রেণির অঙ্কিতা মুর্মু বা জগন্নাথডি গ্রামের চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া বিক্রম মুর্মুর সৃষ্টিতে শুধু প্রকৃতির রূপই ফুটে উঠেছে।
অযোধ্যা পাহাড়ের খুদে পড়ুয়াদের এই কর্মশালায় নিয়ে এসেছিলেন শিক্ষক সুচন্দ্র হেমব্রম ও মণিরাম হাঁসদারা। তাঁদের কথায়, “ওদের তো সে ভাবে আঁকার প্রথাগত শিক্ষা নেই। বাবা-কাকাদের প্রতিদিন দারিদ্রের সঙ্গে লড়তে হয়। তবু ওরা যতটুকু এঁকেছে, সেটাই অনেক বড় শিল্প।” কর্মশালা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বিশ্বভারতীর পাঠভবনের শিক্ষক কালীচরণ হেমব্রম বলেন, “যাঁরা এখানে যোগ দিয়েছে, তাদের কতজনের প্রথাগত তালিম রয়েছে জানা নেই। সকলের না হলেও বেশ কয়েকজনের প্রতিভা রয়েছে।” তিনি জানান, আদিবাসী ছেলেমেয়েরা ছোটবেলা থেকে ঘরের দেওয়ালে আঁকিবুকির মাধ্যমে আপনা আপনিই আঁকার পাঠ নেয়। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা কিছুটা হলেও বদলে যাচ্ছে। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম, ওই পাঠ তাঁদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। প্রয়োজন শুধু চর্চার। |