|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
দ্রুত বিচারের দৌড়ে পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়েই |
সারা দেশে নিম্ন আদালতে আড়াই কোটি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। পশ্চিমবঙ্গে কুড়ি লাখের বেশি।
লোক আদালত, পারিবারিক আদালত, দ্রুতগামী আদালত, সামাল দেওয়ার নানা উদ্যোগ হয়েছে।
নানা রাজ্যে তার নানা মাপের সাফল্য। পশ্চিমবঙ্গ, যথারীতি, ঢিমে তেতালায়। |
বিবেক দেবরায় |
এর আগে (‘আদালতে কত মামলা...’, ২৪-৭) বিচারবিভাগ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছি। আজ বলব দেশের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের জেলা এবং স্থানীয় আদালতের কথা। সারা দেশে নিম্নতর আদালতগুলিতে ২ কোটি ৫৫ লক্ষ মামলা ঝুলে আছে, তার মধ্যে ৭৩ লক্ষ হল দেওয়ানি মামলা, বাকি ফৌজদারি। মোট বকেয়া মামলার ৭০ শতাংশ আছে সাতটি রাজ্যে: উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, কর্নাটক, রাজস্থান। পশ্চিমবঙ্গের (আন্দামান ও নিকোবর সহ) নিম্ন আদালতে বকেয়া মামলার সংখ্যা ২২ লক্ষ, তার মধ্যে ১৭ লক্ষ ফৌজদারি। নিষ্পত্তির তুলনায় নতুন মামলার সংখ্যা যদি দেখি, তা হলে পশ্চিমবঙ্গে ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে অবস্থা উদ্বেগজনক। এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় কী করা হচ্ছে?
কয়েকটা দৃষ্টান্ত দিই। প্রথমে লোক আদালতের কথা বলি। মূল বিচারব্যবস্থা মারফত মামলার নিষ্পত্তি করতে দেরি হয় বলে লোক আদালত গঠন করা হয়েছিল। দুর্বল শ্রেণির মানুষ যাতে বিনা খরচে যথাযথ আইনি সহায়তা পান, অর্থনৈতিক বা অন্য দিক থেকে পিছিয়ে থাকার ফলে যাতে কেউ আইনি পরিষেবা থেকে বঞ্চিত না হন, সেই উদ্দেশ্যে ১৯৮৭ সালে লিগাল সার্ভিসেস অথরিটিজ অ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়। ২০০২ সালে এই আইন সংশোধন করে জন-পরিষেবার ক্ষেত্রে স্থায়ী লোক আদালত প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা হয়। এর আগে ছিল ন্যায় আদালত, কিন্তু তার পরিসর নির্দিষ্ট ছিল নির্ধারিত ছোটখাটো ব্যাপারে। লোক আদালতের ক্ষেত্রে তেমন কোনও সীমারেখা টানা হয়নি। আদালতে না গিয়ে লোক আদালতে যাওয়া যায়, এমনকী বিবদমান পক্ষগুলি চাইলে নিজেরা বোঝাপড়া করে আদালতে ঝুলে থাকা দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলার নিষ্পত্তির জন্যও কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া লোক আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে। লোক আদালতে কোনও কোর্ট ফি লাগে না, যদি সংশ্লিষ্ট বিবাদের নিষ্পত্তির জন্য আগে অন্য আদালতে মামলা রুজু করা হয়ে থাকে, তা হলে সে জন্য প্রদত্ত কোর্ট ফি ফেরত দেওয়া হয়। আসল শর্ত হল, দু’পক্ষকেই লোক আদালতে যেতে সম্মত হতে হবে, তার সিদ্ধান্তও মেনে নিতে হবে। |
|
আমাদের আদালত। সিউড়ি, বীরভূম, মে, ২০১২। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় |
এত রকমের সুবিধে এবং সুব্যবস্থা আছে, সুতরাং লোক আদালত দারুণ সফল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি, অন্তত সব রাজ্যে হয়নি। লোক আদালতের সংখ্যার তুলনায় সেখানে নিষ্পত্তি হওয়ার মামলার সংখ্যা কত এই অনুপাতটিকে আমরা লোক আদালতের কার্যকারিতা বা সাফল্যের একটা মাপকাঠি বলে ধরতে পারি। এই মাপকাঠি অনুসারে যে রাজ্যগুলির সাফল্য দারুণ, সেগুলি হল বিহার, গুজরাত, হরিয়ানা, জম্মু ও কাশ্মীর, ঝাড়খণ্ড, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, পঞ্জাব, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশ। লক্ষণীয়, এই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ নেই। একটা তুলনা দেওয়া যাক। গুজরাতে একটি লোক আদালতে বছরে গড়পড়তা ১ লক্ষ ২৫ হাজার থেকে ২ লক্ষ বিবাদের নিষ্পত্তি হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যাটা ৩,৫০০ থেকে ৫,০০০।
এ বার আসি আর একটি উদ্যোগের কথায়। একাদশ অর্থ কমিশন ১৭৩৪টি দ্রুতগামী আদালত (ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট) গঠনের সুপারিশ করেছিল। যে সমস্ত বিচারাধীন কয়েদি দু’বছরের বেশি কারাবাস করেছে, এই আদালতগুলিতে তাদের মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির উপর বিশেষ জোর দিতে বলেছিল কমিশন। দ্রুতগামী আদালত ব্যাপারটা তখন থেকে চালু আছে। লক্ষ্য ছিল, এই আদালতগুলিতে বছরে ৫ লক্ষ মামলার নিষ্পত্তি হবে। ২০০০ থেকে ২০০৫, এই পাঁচ বছরে নিষ্পত্তি হয়েছে মোট ৮ লক্ষ মামলা। পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকানো যাক। পশ্চিমবঙ্গে ১১৯টি দ্রুতগামী আদালত আছে। ২০০৭ সাল পর্যন্ত তারা মোট ৫৮,০০০ মামলার নিষ্পত্তি করেছে। তামিলনাড়ুতে এমন আদালতের সংখ্যা ৪৯, পশ্চিমবঙ্গের অর্ধেকের কম; নিষ্পত্তি হওয়া মামলার সংখ্যা আড়াই লাখের বেশি, অর্থাৎ চার-পাঁচগুণ।
এ বার পারিবারিক আদালত। বিবাহ, দাম্পত্য ও অন্যান্য পারিবারিক বিবাদের দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ১৯৮৪ সালে এই আদালত প্রথম তৈরি হয়। দশ লক্ষ বা তার বেশি জনসংখ্যাবিশিষ্ট এলাকায় এই আদালত স্থাপনের কথা। এখানে যে সব বিষয়ে মামলা করা যায়, তাদের মধ্যে আছে বিবাহবিচ্ছেদ ও সংশ্লিষ্ট খোরপোষ, সম্পত্তি বণ্টন ও সন্তানের ভরণপোষণ সংক্রান্ত বিবাদ, সন্তানের দেখভালের অধিকার, কিশোর অপরাধ, পারিবারিক হিংসা ইত্যাদি। নারীর ক্ষমতায়ন সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির দ্বাদশ রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছে, প্রত্যেকটি জেলায় একটি পারিবারিক আদালত গঠন করা উচিত। এই আদালত গঠনের এবং তার কাজকর্ম চালানোর অর্ধেক খরচ বহন করে কেন্দ্রীয় সরকার। পশ্চিমবঙ্গে পারিবারিক আদালত আছে তিনটি, কেরলে এগারোটি। কেরলে পারিবারিক আদালতে বছরে গড়ে ১৯,০০০ বিবাদের নিষ্পত্তি হয়, পশ্চিমবঙ্গে ৫০০-রও কম।
কয়েকটি রাজ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা হচ্ছে। কোথাও কোথাও নিম্ন আদালতে শিফ্টও চালু করে দেখা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এমন কোনও চেষ্টা হয়েছে বলে জানা নেই। একটা ব্যতিক্রম হল স্থানীয় গোষ্ঠী বা কমিউনিটি ভিত্তিক আদালত। এটি পঞ্চায়েতি বিচারের থেকে আলাদা। পশ্চিমবঙ্গে সালিশি আদালতে যাঁরা যান তাঁরা প্রধানত খেতমজুর, প্রান্তিক বা ক্ষুদ্র চাষি, গ্রামীণ শ্রমিক ও মেয়েরা। এ ছাড়া বিচারের ব্যবস্থায়, বিশেষত ফৌজদারি মামলায়, উন্নতিসাধনের আর কোনও চেষ্টা কি পশ্চিমবঙ্গে হয়েছে? কেউ সে জন্য বিশেষ কোনও উদ্যোগ করছেন? আমার অন্তত চোখে পড়েনি, কানে আসেনি।
|
দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতিবিদ |
|
|
|
|
|