বিরোধিতা, সমালোচনা নিয়ে এত উদ্বেগ কেন?
ভিন্ন মতকে যত মর্যাদা দেবেন, জনপ্রিয়তা বরং তত বাড়বে। লিখছেন
উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় |
পাঁচ দফায় পঞ্চায়েত নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গে অভূতপূর্ব। এই নির্বাচন নিয়ে পাঁচ মাস ধরে নিরন্তর বিতর্ক তার চেয়েও চমকপ্রদ। আইনি লড়াই, সাংবিধানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, সিঙ্গল বেঞ্চ, ডিভিশন বেঞ্চ হয়ে অবশেষে সুপ্রিম কোর্ট আপাতদৃষ্টিতে একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। ‘কে প্রথম কোর্টে গিয়েছি’ গেয়ে রাজ্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনও পরস্পরের দিকে অপাঙ্গে তাকাতে পারেন। কিন্তু আবার এই বিতর্ক-বিশ্লেষণগুলির সাহায্যে পঞ্চায়েত বিষয়ে সমাজে একটা আলোচনার পরিবেশ বজায় রাখা গেল, অতীতে যা হয়নি।
ভোটের প্রচারে শাসক দলের প্রতিনিধিরা নিয়ম করে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে গালমন্দ করে গেলেন। এটা না করলেও কিন্তু ভোটে ভাল ফলই হত। আর, শুধু মীরা পাণ্ডের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকত না, মুখ্যমন্ত্রীও অধিকতর মহিমান্বিত হতে পারতেন। সেই সুযোগ এ বারই এসেছিল। |
ঠিক একই কথা বলা যায় রাজ্য মানবাধিকার কমিশন সম্পর্কে। ১৯৯৩-তে কেন্দ্রীয় মানবাধিকার কমিশন গঠিত হওয়ার পর রাজ্যগুলিতেও এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। অন্য নানা রাজ্যের তুলনায় এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে কিছুটা নিরপেক্ষতার একটা ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে। ‘পরিবর্তন’-এর পরেও সেটা বজায় ছিল মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান করে যাঁকে আনলেন, তিনি শুধু বিচারপতি নন, আইন-বিশ্লেষকও। অশোক গঙ্গোপাধ্যায় এই মুহূর্তে দেশের সর্বাধিক সক্রিয় কমিশন চেয়ারম্যান। সর্বাধিক বিতর্কিত ও (মৌখিক ভাবে) আক্রান্তও। অম্বিকেশ, শিলাদিত্য, মৌসুমী-টুম্পা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অশোকবাবুর সক্রিয়তায় রাজ্য সরকার ক্ষুব্ধ। অথচ উল্টোটাই হওয়া উচিত ছিল। রাজ্য পুলিশ যদি মুখ্যমন্ত্রীরও অগোচরে অতি-সক্রিয় হয়ে অন্যায় করে বা নিষ্ক্রিয় থেকে অন্যায়ে প্রশ্রয় দেয়, তবে মানবাধিকার কমিশন তা চিহ্নিত করবে, সেটা তো খুব স্বাভাবিক। এই প্রতিষ্ঠানটির কাজ নাগরিকের পাশে দাঁড়িয়ে তার স্বাধীনতা ও অধিকার সম্পর্কে সরকারকে সতর্ক করা। সরকার কাজ করতে গিয়ে কখনও অসংযত হয়ে পড়তে পারে, ভুল বা অন্যায় করতে পারে। সেই অবস্থায় সরকারকে বাঁচিয়ে নাগরিক অধিকার রক্ষাই কমিশনের কাজ। তাকে ক্রমাগত মৌখিক আক্রমণ করে অথবা তার সুপারিশ একটাও না-মেনে সরকার নিজেরই অমর্যাদা করেছে।
আসলে মুখ্যমন্ত্রী বোধহয় ভাবছেন, যে-কোনও সমালোচনা বা বিরোধাভাস তাঁর জনপ্রিয়তা কমাবে। কিংবা হয়তো পূর্বতন কোনও ‘আমরা-ওরা’ থেকে তিনি কিছুতেই বেরোতে পারছেন না। তাই কখনও কার্টুন-কাণ্ড, কখনও তানিয়া-শিলাদিত্য-মৌসুমী-টুম্পাদের মুড়ি-মিছরির মতো ‘মাওবাদী’ তকমা দান। তাঁর এক মন্ত্রী নাকি খোলা চোখে বেলঘরিয়া স্টেশনে ‘মাওবাদী’দের চা খেতেও দেখে ফেলেছেন! সরকারি গ্রন্থাগারে বিশেষ বিশেষ সংবাদপত্র নিষিদ্ধ। নির্বাচনী প্রচারে এ-চ্যানেল ও-চ্যানেলের প্রতি বিষোদ্গার চলছে। আর চ্যানেলে যারা যায়, তাদের তো চোখে কাজল পরা পর্যন্ত নিষিদ্ধ।এত কিছুর কিন্তু কোনও প্রয়োজন ছিল না। পঞ্চায়েতের ফল দেখে মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, নিছক সমালোচনা বা বিরোধী মতামত ভোট কমায় না। থাক-না শাসককে ব্যঙ্গ করে রকমারি কার্টুন বা মজাদার ছড়া, কিংবা কিছু বেয়াড়া প্রশ্ন বা ঝগড়ার উপাদান। টিভি চ্যানেলের সান্ধ্য মজলিশের বিতর্ক যাঁর ভাল লাগে শুনুন, যাঁর ভাল লাগে না বই পড়ুন, বা সিরিয়ালে মনোনিবেশ করুন। মুখ্যমন্ত্রী এই বহুমাত্রিকতাকে বাঁচিয়ে রাখুন। তাতে সামাজিক সুস্থতা বাঁচবে, শাসক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতাও কমবে না। বস্তুত সমাজজীবন যত গণতান্ত্রিক চর্চার আস্বাদ পাবে ততই সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়বে। মুক্ত সমাজ ও নাগরিক সচলতা শাসকের মহিমা বিস্তার করে, হ্রাস করে না। মুখ্যমন্ত্রী সে সুযোগ নেবেন কি?
|
বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক |