ফিরে ভাবা দরকার, খণ্ডের সঙ্গে বড় দেশটার কথাও কেন ভাবতে বলছিলেন নেহরুরা।
রাজ্য পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা হোক। কিন্তু তাতে যেন কেবল রাজনীতিকরাই না থাকেন।
আলোচনাটা হওয়া দরকার আর একটু বড় মাপে। |
সেই পঞ্চাশের দশকে, জওহরলাল নেহরু মোটেও অন্তর থেকে সমর্থন করেননি অন্ধ্র কিংবা অন্ধ্রপ্রদেশের সিদ্ধান্ত। অন্ধ্র গঠন ও অন্ধ্রপ্রদেশ গঠন, দুই ক্ষেত্রেই তাঁর গভীর খুঁতখুঁতানি ছিল, এবং দুটি সিদ্ধান্তই হয় তাঁর মতের বিরুদ্ধে, পরিস্থিতির চাপে। মাদ্রাজ থেকে তেলুগু-ভাষী অঞ্চলগুলিকে আলাদা করে নিয়ে যখন পৃথক প্রদেশ অন্ধ্র রাজ্য তৈরি হল ১৯৫৩ সালের ১ অক্টোবর, কুর্নুল হল রাজধানী, প্রধানমন্ত্রী নেহরু রাজাগোপালাচারিকে লিখলেন, “আমি নিশ্চিত যে কাজটা ভাল হচ্ছে না।” আবার ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর যখন হায়দরাবাদ ও তেলঙ্গানা অঞ্চলকে রায়লসীমা ও অন্ধ্র উপকূলের সঙ্গে যুক্ত করে অন্ধ্রপ্রদেশ তৈরি হল, হায়দরাবাদ হল রাজধানী, তখনও নেহরু অপ্রসন্ন হলেন। তাঁর মনে হল, সমাজ ইতিহাস সংস্কৃতি অর্থনীতি সব রকম বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও কেবল ভাষার দাবিতে তেলঙ্গানাকে অন্ধ্র রাজ্যের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার কোনও যুক্তি নেই, ব্যাপারটার মধ্যে যেন রীতিমত ‘সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের গন্ধ’ আছে। কিন্তু তবু ঘটনাটা ঘটলই যখন, তাঁরই নির্দেশে কতকগুলি শর্ত রাখা হল, বিশালান্ধ্র-পন্থী ও তেলঙ্গানা-পন্থী দুই পক্ষের মধ্যে ভদ্রলোকের চুক্তি রইল, যাতে, নেহরুরই ভাষায়, ‘বিবাহবিচ্ছেদের অবকাশ’টুকু রাখা যায়। |
সাতান্ন বছর পর বিয়েটা তা হলে ভেঙেই গেল। তেলঙ্গানা এখন ২৯তম রাজ্য হতে চলেছে। কী ভাবতেন নেহরু, জানতে ইচ্ছে করে, কেননা এখনকার নেতারা যে ভাবে প্রদেশগঠনের বিষয়টি বিবেচনা করেন, নেহরুরা সে ভাবে ভাবতেন না। সবে স্বাধীনতার আস্বাদপ্রাপ্ত ও দেশভাগের হিংস্রতায় জর্জরিত ভারতে প্রদেশ ভাগাভাগির আলোচনায় একটা বড় দর্শনের কথা প্রায়ই উঠে আসত, কতকগুলি বড় চিন্তা বা লক্ষ্য থাকত: নানা অঞ্চলের মধ্য দিয়ে একটা বৃহৎ ‘দেশ’ বা রাজনৈতিক অস্তিত্ব তৈরির চিন্তা আজ যে বিষয়টা অর্থহীন, এলেবেলে বলে মনে করা হয়। আজ আমরা প্রদেশ গঠন বা পুনর্গঠনের প্রশ্নে যে সব যুক্তি শুনি, সেগুলি সবই ব্যবহারিক। রাষ্ট্রদর্শন ইত্যাদির জায়গা তাতে নেই। নেহরুর জীবনীকার সর্বেপল্লী গোপাল লিখেছেন, অন্ধ্রপ্রদেশের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে নেহরু বলেছিলেন, প্রদেশ যা-ই হোক, প্রতিটি ভারতীয়ের একটা বৃহৎ ভারতের স্বার্থ মাথায় রেখেই বড় হওয়া উচিত। এ সব কথা এখন হাস্যকর বলে গণ্য হবে। ভারত, দেশ, এ সব আবার কী, এখন অঞ্চল, গোষ্ঠী, স্বার্থ ইত্যাদির দিন।
অঞ্চলের দাবিটি অবশ্য নতুন নয়, সেই পঞ্চাশের দশকের স্টেটস রিঅর্গানাইজেশন কমিশনের দিন থেকেই শোনা যেত ক্ষুদ্র আঞ্চলিক স্বার্থে ক্ষুদ্র রাজ্যের দাবি। মহারাষ্ট্রের মতো পিছিয়ে-পড়া মরাঠিভাষী কৃষিভিত্তিক একটা বড় অঞ্চলের ‘দাসত্ব’ থেকে মুক্ত করে আলাদা একটি বহুভাষী বাণিজ্যসফল বিত্তশালী বম্বে রাজ্য গঠনের প্রস্তাবও তো উঠেছে তখন। তবে কিনা, স্বভাবতই, গত কয়েক দশকে আরও অনেক জোরদার হয়েছে ছোট রাজ্য গঠনের দাবি, গঠিত হয়েছে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট প্রদেশও। বহু আন্দোলনের পর এসে গেল তেলঙ্গানাও। আরও আন্দোলনের পথ ধরে ভাগ্যপরীক্ষায় এগিয়ে আসছে গোর্খাল্যান্ড, বড়োল্যাণ্ড, বিদর্ভ, হরিৎ প্রদেশ ইত্যাদি। পঞ্চাশ বছর আগে যে দাবি ছিল একটি-দুটি, ইতস্তত, এখন সেই দাবিই রমরম করছে, জনপ্রিয়তর হচ্ছে।
রাজনীতির সৌজন্যেই এই জনপ্রিয়তা। নতুন ছোট রাজ্যের দাবি মানেই যেন নিপীড়িতের দাবি, নিষ্ফলের আর হতাশের দাবি, বড়-র আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ছোট-র আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি। অর্থাৎ রাজনীতির মুদ্রায় এদের সাফল্য-সম্ভাবনা নিশ্চিত, নেতাদের রাজনীতির প্ল্যাটফর্ম হিসেবে এদের উপকারিতা চমকপ্রদ। গণতন্ত্রের যে তৃণমূলীকরণ নিয়ে ভারতের গর্ব, তারই এক আবশ্যিক ভিত্তি ‘আইডেন্টিটি পলিটিকস’। সেই আত্মপরিচয়ের রাজনীতিরই স্বাভাবিক পরিণতি, ছোট রাজ্যের দাবি। সুতরাং, ভারতের গণতন্ত্রের ‘সাফল্য’ই ভারতকে আজ এই অনন্ত খণ্ডীকরণের কুরুক্ষেত্রে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যে নেহরুরা সে দিন সব খণ্ডতার ঊর্ধ্বে একটি দেশীয় অস্তিত্ব ও তার গণতন্ত্রকে তৈরি করতে চাইছিলেন, তাঁরা আজ এই অবস্থায় কী ভাবতেন, কে জানে।
মাস-ছয়েক আগে রামচন্দ্র গুহ একটি লেখায় বলেছিলেন, ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের কাজটি যে ভাবে হয়েছিল, তাতে সে দিন ভারতের ঐক্যরক্ষার লক্ষ্যটি ভাল ভাবেই পূর্ণ করা গিয়েছিল; আজ যেহেতু সেই লক্ষ্য আর তত প্রাথমিক নয়, ছোট ছোট রাজ্যে দেশকে ভাঙতে ক্ষতি কী? তেলঙ্গানার আন্দোলন যেহেতু সবচেয়ে পুরনো ও দীর্ঘস্থায়ী, সবচেয়ে হিংসাত্মক, তাই তেলঙ্গানা পৃথক রাজ্য হোক, এই তাঁর বক্তব্য। এবং সেই সূত্রেই ছোট রাজ্যের নীতির প্রতি তাঁর সমর্থন। তবে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের লক্ষ্যটি ছিল ভারতের ঐক্যসাধন, রামচন্দ্র গুহের এই যুক্তি ঠিক নয়। প্রবল আন্দোলনের চাপে ভাষাভিত্তিক অঞ্চলের দাবি বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয়েছিল নেহরুকে। তা মেনে নিয়ে দেশের তেমন কিছু বড় ক্ষতি হয়নি, এটুকুই কেবল বলা যায়।
তেলঙ্গানার ক্ষেত্রটি সত্যিই আলাদা। হিংসাত্মক বা পুরনো বলেই নয়, তেলঙ্গানার পক্ষে একটা অন্য যুক্তি রয়ে গিয়েছে, যেটা নেহরু সে দিন বলতে চেয়েছিলেন। ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ ভাগাভাগির যুক্তিটি বাধ্য হয়ে মেনে নিতে গিয়ে তাঁর মনে হয়েছিল, কেবল ভাষাকেই চরম গুরুত্ব দেওয়া ঠিক নয়। ভাষা-সংস্কৃতি (linguistic-cultural) বলতে তো শুধু ভাষাই বোঝায় না, অর্থনৈতিক-সামাজিক বাস্তবটাও সেখানে গুরুত্বপূর্ণ। প্রাক্তন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য-অংশ উপকূলীয় অন্ধ্র এবং জনজাতি-অধ্যুষিত নিজাম-শাসিত স্বাধীন দেশীয় রাজ্য হায়দরাবাদ তথা তেলঙ্গানার মধ্যে যতই তেলুগু ভাষার সেতু থাকুক, দূরত্ব তাদের অনেক যোজন, ক্ষমতা ও সম্পদের বৈষম্য তীব্র। তেলঙ্গানাকে বাধ্য হয়েই সে দিন অন্ধ্রপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করতে হয়েছিল, আবার বাধ্য হয়েই আজ তেলঙ্গানাকে অন্ধ্র থেকে মুক্ত করতে হল: এর মধ্যে তাই একটা ঐতিহাসিক ন্যায্যতা দেখা সম্ভব।
কিন্তু সেই ন্যায্যতা স্বীকার করেও পরের প্রশ্ন তুলতেই হয়। তবে কি ছোট রাজ্যই একমাত্র সমাধান? রামচন্দ্র গুহের মতো চিন্তাবিদ থেকে শুরু করে ভারতীয় জনতা পার্টির মতো জাতীয় রাজনৈতিক দল এবং ক্ষুদ্রতর রাজ্যের দাবিধারীরা সকলেই প্রশাসনিক সুবিধা এবং অর্থনৈতিক সম্পদের সুষম বণ্টনের যুক্তিটিকে বিশেষ প্রাধান্য দেন। যুক্তিটি গুরুতর। বড় প্রদেশের যাতায়াত, যোগাযোগ-ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা অনেক সময়েই প্রাদেশিক উন্নয়নের গতি ও উন্নয়নের ফলাফলের সুষম বণ্টনের পথ রোধ করে দাঁড়ায়। যে যুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় দেশকে গাঁথা হয়, সেই একই বিকেন্দ্রীকরণের যুক্তি এ ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যেতে পারে। তার উপরে গোর্খাল্যান্ডের মতো কোনও ক্ষেত্র, যেখানে একটা সংস্কৃতি-জাতিগত বিভেদও স্পষ্ট, সেখানে আলাদা ছোট রাজ্য না গড়ার কারণ কী-ই বা হতে পারে, বলবেন এঁরা। ছোট রাজ্য যে সফল পরিচালনার দৃষ্টান্ত দেখাতেই পারে, তার উদাহরণ তো আছেই, সমতলের ছত্তীসগঢ় কিংবা পাহাড়ের সিকিম।
মুশকিল হল, সফল ছোট রাজ্যের উদাহরণের পাশাপাশি অসফল ছোট রাজ্যের উদাহরণ দেখানোও কঠিন নয়, যেমন সমতলের ঝাড়খণ্ড, কিংবা পাহাড়ের নাগাল্যাণ্ড। আবার বড় সফল রাজ্যও তো রয়েছে, গুজরাত বা তামিলনাড়ু। আজ যদি নবগঠিত তেলঙ্গানা রাজ্য হঠাৎই তার মাথাপিছু আয় তরতর করে বাড়িয়ে যেতে থাকে, তা হলে কি সব কৃতিত্ব তার ‘ছোটত্ব’ই পাবে, যে তেলঙ্গানা অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে আলাদা হয়েও আয়তনের বিচারে গোটা দেশের মধ্যে দ্বাদশ বৃহত্তম প্রদেশ? অর্থাৎ প্রদেশের আয়তনের উপরই তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য নির্ভর করে, এই যুক্তি দাঁড় করানো যায় না। সম্ভবত আয়তন নয়, অন্য নানা কারণ আছে এই সাফল্য-অসাফল্যের। প্রতিযুক্তি হতে পারে: মোটের উপর ভদ্র আয়তনযুক্ত প্রদেশের মধ্যেও আঞ্চলিক উন্নয়ন বা সম্পদের সুষম বণ্টন অবশ্যই করা সম্ভব, যথাযথ পরিকল্পনা ও পরিচালনা থাকলে। প্রদেশগুলি সে কাজে যদি ব্যর্থ হয়েও থাকে এত দিন, সেই ব্যর্থতা নিরাময়ের চেষ্টা করা সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গে জঙ্গলমহলে অনেকগুলি দশকে কিছুই তেমন করা হয়ে ওঠেনি বলে আগামী দশকগুলিতেও কিছুই পরিকল্পনা মাফিক করা যাবে না, সুলভ খাদ্যশস্য বণ্টন কিংবা সুগম্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করা যাবে না, এটাই বা কেন ধরে নিতে হবে? যে বিকেন্দ্রীকরণের যুক্তি ছোট রাজ্যের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে, সেই একই যুক্তি একটি মাঝারি মাপের রাজ্যেও প্রয়োগ করা সম্ভব, ক্ষমতা ও সম্পদের বিস্তার ও বণ্টন সম্ভব প্রশাসনের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর স্তরে, এমনকী কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে আঞ্চলিক স্বশাসনের কথাও ভাবা সম্ভব।
কেবল সম্ভব নয়, এই ভাবে ভাবাটা জরুরিও বটে। কেননা খণ্ডীকরণের যুক্তির মুশকিল হল, তার কোনও যৌক্তিক সীমা নেই। কত ছোট হলে ছোট-র দাবি শেষ হবে, ইয়ত্তা নেই। ঊনত্রিশ হলে ঊনপঞ্চাশ নয় কেন, নিরানব্বই-ই বা নয় কেন? যিনি বলেন, নিরানব্বই-তে আপত্তি কী, তাঁকে কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, কেবল সংখ্যাটাই এখানে প্রধান বিচার্য নয়, সংখ্যায় পৌঁছনোর এই চলমান পদ্ধতিটি, তার বাস্তব প্রেক্ষিতটি, হিংসা ও দ্বন্দ্বের এই অনন্ত ঘূর্ণিপাক অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যে তেলঙ্গানা আজ নিজেকে ছোট বলছে, সেও নিশ্চয়ই হোমোজেনাস বা একশৈলিক নয়, তার অভ্যন্তরেও আরও ছোট-র দাবি আছে! যদি না-ও থাকে তেমন দাবি, যে পদ্ধতিতে তেলঙ্গানা আন্দোলন হল, সেই পদ্ধতিতেই তার অভ্যন্তরের ভবিষ্যৎ আন্দোলন জন্ম নেবে, এই সম্ভাবনা প্রবল। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব-দীর্ণতার শেষ কোথায়? একটা কোথাও দাঁড়ানো দরকার। ফিরে ভাবা দরকার, ঠিক কী ভেবে খণ্ডের সঙ্গে বড় দেশটার কথাও ভাবতে বলছিলেন নেহরুরা। দিকে দিকে আজ যে আগুন জ্বলছে, সেটা নেবানোর জন্যই নয় কি? কেবল প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থ ও আত্মপরিচয়ের সংঘর্ষময় অ্যাজেন্ডাই কি রাজনৈতিক স্থিতি ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার একমাত্র রাস্তা? দ্বিতীয় স্টেটস রিঅর্গানাইজেশন কমিশন-এর প্রস্তাব উঠেছে। হোক সেই কমিশন। অন্ধ্রপ্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত থেকে জন্ম নিয়েছিল প্রথম এস আর সি। অন্ধ্রপ্রদেশ ভাঙার সিদ্ধান্ত থেকে জন্ম নিক দ্বিতীয় এস আর সি। কিন্তু প্রথম বারের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেই, তাতে যেন শুধু রাজনীতিকরাই না থাকেন। আলোচনাটা একটু বড় মাপে হওয়া দরকার, স্বার্থ-রাজনীতির প্রতিযোগিতা পেরিয়ে, পুরনো বস্তাপচা ‘দেশ’-এর কথা আর এক বার ফিরে আসুক সেখানে। |