পশ্চিমবঙ্গ ফেল করিয়াছে, এই সংবাদে আর নূতনত্ব নাই। বস্তুত, কোন পরীক্ষায় ফেল করিল, সেই প্রশ্নও কেহ আর সচরাচর করেন না। এই দফায় বিচার্য ছিল বয়স্ক শিক্ষায় উন্নতি। কোন রাজ্যে বয়স্ক শিক্ষার্থীরা কত দূর শিখিয়াছেন, তাহা পরখ করিবার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক দেশ জুড়িয়া একটি পরীক্ষার আয়োজন করিয়াছিল। পাশের হারে পশ্চিমবঙ্গ গোটা দেশে নিম্নতম স্থানটি অর্জন করিয়াছে। মধ্যপ্রদেশে প্রায় ৯৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পাশ করিয়াছেন, বিহারেও প্রায় ৮৭ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে পাশের হার মাত্র ৪২ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে যে বয়স্ক শিক্ষার প্রকল্পটি গতি এবং পথ উভয়ই হারাইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই।
কেন পশ্চিমবঙ্গের এই অবস্থা হইল, তাহা বুঝিতে আরও বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন। কিন্তু শুধুমাত্র এই চিত্রটির প্রেক্ষিতেই কিছু কথা বলা চলে। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে আর পাঁচটি কাজের মতোই এই ক্ষেত্রটিতেও কাহারও মন নাই। বয়স্ক শিক্ষার কাজ যথারীতি চলিতেছে কি না, যাঁহাদের নাম নথিভুক্ত হইয়াছে তাঁহার নিয়মিত ক্লাসে আসিতেছেন কি না, সেই নজরদারিটি যথাযথ আগ্রহ ও নিষ্ঠার সহিত সম্পন্ন হয় না। যাঁহাদের নজরদারি করিবার কথা, তাঁহাদের উপর নজর রাখিবারও কেহ নাই। ফল যাহা হওয়ার, হইয়াছে। এই রোগটি কেবলমাত্র বয়স্ক শিক্ষার ক্ষেত্রেই নহে, সর্বত্র দৃশ্যমান। কাজে ফাঁকি দিয়াও পার পাইবার এত রকম পথ এই রাজ্যে খোলা আছে যে কাজ করিবার কথা কেহ বিশেষ বিবেচনা করেন না। বয়স্ক শিক্ষার ক্ষেত্রে নজরদারির ভূমিকাটি আরও বেশি, কারণ অর্থনীতির পরিভাষায় যাহাকে ‘ইনসেনটিভ’ বলা হয়, শিক্ষার্থীদের নিকট তাহা নাই অন্তত প্রত্যক্ষ ভাবে নাই। অক্ষরজ্ঞান হইলেই তাঁহাদের অর্থোপার্জনের কিছু সুবিধা হইবে, এমন সম্ভাবনা প্রায় নাই বলিলেই চলে। শিক্ষার প্রসারের মূল উদ্দেশ্য যে ক্ষমতায়ন, তাহার ফল হাতেগরম নহে। কাজেই, পড়াইতে হইলে খানিক ধরিয়াই আনিতে হইবে। তাহার জন্য উদ্যোগ প্রয়োজন। সর্বব্যাপী ফাঁকিবাজির সংস্কৃতিতে সেই উদ্যোগ বিরল হওয়াই স্বাভাবিক। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা বলে, বয়স্ক শিক্ষার সাফল্য সচরাচর সামাজিক ‘বিপ্লব’-এর ফল। অর্থাৎ, শিক্ষার স্বার্থেই যে শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, সমাজে সেই বিশ্বাস গভীর হইয়াছে এবং সমাজ সেই অভিমুখে হাঁটিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গেও সাফল্য ভিন্ন পথে আসিবে না। শিক্ষার গুরুত্বে সমাজের আস্থা জাগাইবার দায়িত্ব সরকার পালন করিবে কি? শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু পশ্চিমবঙ্গের বয়স্ক শিক্ষায় ফেল করিবার সংবাদটি যে ভঙ্গিতে উড়াইয়া দিয়াছেন, তাহাতে সংশয় হয়। ব্যর্থতাকে স্বীকার করিবার সাহসই সাফল্যের প্রথম ধাপ। পশ্চিমবঙ্গের শাসকদের সেই সাহসের অভাব আছে বলিয়াই সন্দেহ হয়। বয়স্ক শিক্ষার প্রসারের কাজটি সম্পূর্ণ সদিচ্ছার সঙ্গে করিতে হইবে। একই সঙ্গে, প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য হইতে নজর সরাইলেও চলিবে না। এই শিক্ষাই মুখ্য, বয়স্ক শিক্ষা তাহার সহযোগীমাত্র কেহ যাহাতে বাদ না পড়িয়া যায়, তাহা নিশ্চিত করিবার পন্থা। বুনিয়াদি স্তরে মনোযোগ দিলে, স্কুলছুটের হার নিয়ন্ত্রণে রাখিতে সচেষ্ট হইলে, স্কুলে স্কুলে যথার্থ শিক্ষার ব্যবস্থা করিলে দীর্ঘমেয়াদে আর বয়স্ক শিক্ষার প্রয়োজন হইবে না। কেরলের দৃষ্টান্ত স্মর্তব্য। আপাতত পশ্চিমবঙ্গ দুই দিকেই মনোযোগ করুক। ফেল করা কাজের কথা নহে। |