উত্তরপ্রদেশের নয়ডা জেলার মহকুমা-শাসক দুর্গাশক্তি নাগপালকে লইয়া এক বহুবর্ণ নাটক মঞ্চস্থ হইতেছে। তিনি রমজান মাসে একটি নির্মীয়মাণ মসজিদের দেওয়াল ভাঙিতে বলিয়া রাজ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করিয়াছেন, না কি যমুনা ও হিন্দন নদ হইতে বেআইনি ভাবে বালি উত্তোলনকারী মাফিয়ার স্বার্থে আঘাত করিয়া শাসক দলের স্থানীয় রাজনীতিকদের বিরাগভাজন হইয়াছেন, সেই তর্ক আপাতত চলিবে। চলুক। উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি পরিচালিত সরকার এবং কেন্দ্রে ইউ পি এ সরকারের মধ্যে দুর্গাশক্তি নাগপালকে কেন্দ্র করিয়া যে দ্বৈরথ ঘনায়মান, তাহার কারণ শ্রীমতী নাগপাল এক জন আই এ এস অফিসার, যাহা একটি কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক পরিষেবা। কেন্দ্রের পাশাপাশি রাজ্য স্তরেও শাসনব্যবস্থা চালনার জন্য যে আমলাতন্ত্র নিযুক্ত, তাহার মেরুদণ্ডই এই আই এ এস অফিসাররা। তাঁহাদের সহিত অবশ্য রাজ্য স্তরের প্রশাসনিক অফিসাররাও থাকেন। কিন্তু প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ, শীর্ষস্থানীয় ও নির্ণায়ক পদগুলি (যেমন মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব-সহ বিভিন্ন মন্ত্রকের সচিবের পদ) সচরাচর আই এ এস-রাই অলঙ্কৃত করিয়া থাকেন।
ভারতীয় শাসনতন্ত্র ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ হইতে যে শাসনপ্রণালী গ্রহণ ও আত্মস্থ করিয়াছে, তাহা পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে আই এ এস এবং সাধারণ ভাবে সরকারি অফিসারদের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তব শাসনপ্রণালীতে তাঁহারা নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেন, নির্বাচিত সরকার ও তাহার মন্ত্রীদের ‘রাস্তার জননেতা’ হইতে দক্ষ প্রশাসকে পরিণত করার প্রক্রিয়াটির প্রয়োজনীয় তদারকিও তাঁহারাই করেন। শাসন পরিচালনার জটিল, বহুমুখী ও বহুমাত্রিক বিষয়গুলি নেতা-মন্ত্রীদের গোচরে আনা, তাঁহাদের সে সব বুঝানো এবং হাতে ধরিয়া শেখানোর কাজও এই অফিসারদেরই। ‘আইনের শাসন’ কেবল আইন প্রণয়ন কিংবা সংশোধনের পরিষদীয় ক্রিয়ার ধারাবাহিকতা নয়, আইন অনুযায়ী শাসনপ্রণালী পরিচালিত হইতেছে কি না, তাহার তত্ত্বাবধানও। আমলারা বিভিন্ন রাজ্য এবং কেন্দ্রের শাসনপ্রক্রিয়ার সহিত প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধনও করিয়া থাকেন এবং আইন অনুযায়ী কী করা যায় না, সে ব্যাপারেও রাজনীতিকদের আগাম সতর্ক করিয়া দেন। তাহা করিতে গিয়া এ দেশে প্রায়শ তাঁহাদের রাজনীতিকদের বিরাগভাজন হইতে হয়। রাজনীতিকরা আই এ এসদের ‘শাস্তি’ দানের স্বেচ্ছাচারে লিপ্ত হন। নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রীদের আমলাদের সাসপেন্ড বা বদলি করার অধিকার আছে। পশ্চিমী গণতন্ত্রেও আমলা-অফিসারদের উপর মন্ত্রীদের এই অধিকার সচরাচর শিরোধার্য। কিন্তু সেখানে কদাচিৎ মন্ত্রীরা এই অধিকার প্রয়োগ করিয়া থাকেন। প্রশাসনের আধিকারিকরা সেখানে নিয়ম মানিয়া কাজ করেন, তাঁহাদের উপরেও কেহ ক্ষমতার ছড়ি ঘুরাইয়া আস্ফালন করেন না। ভারতীয় গণতন্ত্রের গায়ে এখনও রাজতন্ত্রের জোব্বা সাঁটিয়া আছে, হাতে সামন্ততন্ত্রের হুকার নল। আধুনিক গণতন্ত্রে আইনের শাসনের প্রতি রাজনীতিকদের যে দায়বদ্ধতা থাকার কথা, ভারতীয় রাজনীতিকরা ‘জনতার আদালতের রায়ে’ অর্থাৎ জনাদেশের বলে সেই সাংবিধানিক দায়কে অগ্রাহ্য করিতে অভ্যস্ত। তাঁহাদের ধারণা, আইন রচনা, সংশোধন কিংবা রদ করা যেহেতু তাঁহাদেরই কাজ, তাই আইনবিরুদ্ধ কাজে অভিযুক্ত হইলে সংশ্লিষ্ট আইনটিকেই প্রয়োজনে রদ করিয়া দিবেন, তবু আইনের শাসনের প্রতি কোনও নিষ্ঠা দেখাইবেন না। এই অবস্থায় আই এ এস অফিসারদের প্রতি ইচ্ছা মতো শাস্তির হুমকি দেওয়ার অসৌজন্য তো তাঁহাদের পাইয়া বসিবেই। দুর্গাশক্তি নাগপালের ক্ষেত্রে ঠিক কী ঘটিয়াছে, তাহা জল্পনার বিষয়। কিন্তু এই উপলক্ষে ভারতীয় শাসনতন্ত্রের মজ্জাগত অ-গণতান্ত্রিকতার প্রশ্নটি প্রকট হইয়াছে। |