ও আমার বৌদিমণি

সময়:
সন্ধে ৮:৪৫
স্থান: দক্ষিণ কলকাতার একটি প্রেক্ষাগৃহ

সিনেমা শুরু হওয়ার খানিক ক্ষণ পর একদল দর্শক সিনেমা হল-য়ে ঢুকলেন অজয় বহেলয়ের ‘বি এ পাস’ দেখতে। “কী রে বলেছিলি যে ওই রকম অনেক সিন-সিনারি রয়েছে সিনেমায়। এখনও তো শুরু হল না...” এর পর পরদাতে শিল্পা শুক্লকে হাউজকোট খুলতে দেখেই উত্তেজনা বাড়ে। “মুখে বলছে ‘সারিকা আন্টি’, আর দেখ কী করছে! একেই বলে বৌদিবাজি। ভারতীয় সিনেমাতে কী রগরগে জিনিস দেখাচ্ছে!” ভেসে এল এক কণ্ঠ।
২০১৩-র পরদার নষ্টবৌদি হলেন সারিকা (অভিনয়ে শিল্পা শুক্ল)। পাড়ার সব বৌদির থেকে আলাদা। রহস্যময়ী এক নারী। জিগোলো সাপ্লাইয়ের ব্যবসা চালান। মুখে একটা বাঁকা হাসি। পাড়ার এক কলেজপড়ুয়া ছেলেকে ফাঁসিয়ে দিয়ে শুরু করেন ক্লাস নেওয়া। সম্পর্কে তিনি ছেলেটির সারিকা আন্টি। কিন্তু যৌনমিলনের টিপস দেওয়ার সময় তাঁর সঙ্গে আন্টির থেকে বেশি মিল বলিউডের জনপ্রিয় কার্টুন পর্ন চরিত্র সবিতা ভাবির!
সত্যি কি তা হলে বলা সম্ভব যে ভারতীয় সিনেমার বিবর্তনে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে পালটেছে পরদায় বৌদির ইমেজও? যে-বৌদির আর প্রয়োজন হয় না এমন এক দেওর যিনি তাঁকে বাইরের দুনিয়া খড়খড়ির আড়াল থেকে দেখতে বা চিনতে সাহায্য করবেন? যে-বৌদি শুধুমাত্র মাতৃময়ী নারী নন? যিনি নিজের যৌন কামনাকে অস্বীকার করেন না। যিনি কোনও রকম সঙ্কোচ না করেই বলতে পারেন: ‘শিখায়া ম্যায়নে, মজা সব লেঙ্গে!’
ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বৌদির ইমেজ গুরুত্বপূর্ণ হলেও সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই খোলাখুলি ভাবে কিছুই দেখানো হয়নি। হয়তো কিছু সাহসী সংলাপ রাখা হয়েছে, কিন্তু রক্ষণশীল সমাজ বাধ্য করেছে পরিচালকদের পরিমিত হতে। এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় তুলে ধরলেন ‘দ্য ইনার আই’-তে সত্যজিৎ রায়ের অ্যান্ড্রু রবিনসনকে দেওয়া একটি মন্তব্য, যেখানে পরিচালক বলেছিলেন, “বাংলায় একটি রীতি আছে যে বৌদির সঙ্গে তাঁর দেওরের একটি আলাদা সম্পর্ক থাকবে। এটা খুবই স্নেহের সম্পর্ক। বৌদি একমাত্র তাঁর সামনেই আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেন, কিন্তু অন্য পুরুষের সামনে তা পারেন না। এই দেওর অবশ্যই হতে পারেন কোনও কলেজপড়ুয়া। হাতে তাঁর প্রচুর সময়। এবং আবদার করতে পারেন বৌদির কাছে কয়েকটি পদ রেঁধে দেওয়ার জন্য। সত্যি বলতে কী এই সম্পর্ক এর থেকে বেশি ঘনিষ্ঠ। এটা এমন এক ধরনের অন্তরঙ্গতায় পৌঁছে যায় যা ‘চারুলতা’য় দেখানো হয়েছিল। যেখানে ছোট ভাইটি বৌদির প্রতি আকৃষ্ট, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে যেতে ভয় পায়। সে বোঝে যে একটা বিপদ আছে। সুতরাং এমন একটা টেনশনের পরিবেশ তৈরি হয় যা আবার দু’টি চরিত্রের পক্ষেই বেশ মজার। আনন্দের বিষয়টি সেখানে বেশি রকম উপস্থিত কেননা ছেলেটি তাঁর বৌদির সঙ্গে মেশার সামাজিক অনুমোদন পেয়েছে। সুতরাং এখানে একটা সম্ভাবনা থেকেই যায় যে অনেক গভীর একটা সম্পর্ক তৈরি হতে পারে।”
সঞ্জয়ের মতে, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল ‘নষ্টনীড়’ গল্পটি ছিল অনেকটাই আত্মজৈবনিক। সত্যজিৎ রায় কেন্দ্রটা পালটে দিয়েছিলেন। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন এক বিবাহিত আর উপেক্ষিত নারীর জীবন। ষাটের দশকের রক্ষণশীলতার আবরণের মধ্যে সত্যজিৎ রায় যা দেখিয়েছিলেন তার থেকে আর বেশি অন্তরঙ্গ মুহূর্ত সে সময়ে বড় পরদায় দেখানো সম্ভব ছিল না। তখনকার সেই আড়ষ্ট গণ্ডি মধ্যবিত্ত আজ পার হয়ে গিয়েছে।”
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মৈনাক বিশ্বাস। মৈনাকের মতে, “‘চারুলতা’তে যে সময়টা ধরা হয়েছিল সেটা ১৮৮০-র আশেপাশে। তখনকার একজন বিবাহিত নারীর স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ হওয়ার সম্ভাবনা খুব সীমিত ছিল। সেই সামাজিক বা গার্হস্থ্য নিয়মের মধ্যে দেওরের ভূমিকা আজকের মতো নয়। দেওর সেখানে ভাই, সখা এবং নানা অর্থে একমাত্র পুরুষ বন্ধু হয়ে উঠতে পারে। আমার মনে হয় ‘চারুলতা’কে ক্লাসিক হিসেবে বর্ণনা করা হলেও এখনও অনেক অল্পবয়সি দর্শক ছবির মূল বর্ণনাটা বুঝতে পারে না। খুব রাগ হয় যদি প্রশ্ন শুনি, কেন সত্যজিৎ রায় ‘চারুলতা’তে অমল আর চারুর মধ্যে কোনও অন্তরঙ্গ শারীরিক সম্পর্ক দেখাননি। ‘চারুলতা’র মূল প্রসঙ্গ হল দু’জন মানুষের বড় হয়ে ওঠার গল্প। একজন স্বাধীন নাগরিক হয়ে উঠতে পারবে, অন্য জন সেটা পারবে না। চারুর বড় হয়ে ওঠার জন্য যে মূল্যটা দিতে হল তা ছিল মারাত্মক।”
বৌদি-দেওরের সম্পর্ক নিয়ে আরও উল্লেখ্য সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। উঠে আসে জয়া আর সঞ্জয়ের কথা। বলেন, “জয়া (কাবেরী বসু) বিধবা ছিলেন। সম্পর্কে তিনি অপর্ণার (শর্মিলা ঠাকুর) বৌদি। সেই সূত্রে সঞ্জয়েরও (শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়) বৌদি হওয়া উচিত। মনে আছে সিনেমাতে সেই দৃশ্য যেখানে জয়া সঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করছে ‘নার্ভাস লাগছে?’ উত্তরে সঞ্জয় বলে: ‘না’। তার পর জয়া বলে: ‘আমার লাগছে’। এর পরে সঞ্জয়ের হাত নিজের বুকে টেনে নেয়। আমার মনে হয় সেই সময়ে দাঁড়িয়ে দেওর-বৌদির সম্পর্ক নিয়ে এই দৃশ্যটি বেশ সাহসী।”

‘তিন ইয়ারি কথা’
 

‘চারুলতা’
সুদেষ্ণা রায় আর অভিজিৎ গুহ বানিয়েছিলেন ‘তিন ইয়ারি কথা’। তিনটি অল্পবয়সি ছেলে আর পাড়ার এক বৌদিকে নিয়ে গল্প। ফিল্মটি এখন হিন্দিতে ডাব করা হয়েছে। জাতীয় চ্যানেলে দেখানোর কথা চলছে। সুদেষ্ণা বলছেন, “আমাদের সিনেমাতে অল্পবয়সি ছেলেরা দেওয়ালে ফুটো করে বৌদির শোয়ার ঘরে কী হচ্ছে তা দেখার চেষ্টা করে। হয়তো এটাই বৌদিবাজি। কিন্তু বৌদিবাজির সবটাই নেগেটিভ নয়। যখন এই বৌদি আত্মহত্যা করতে যায় তখন এই ছেলেগুলোই তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায়।”
সেপ্টেম্বরে শুরু হচ্ছে সুমন ঘোষের কাদম্বরী দেবীকে নিয়ে সিনেমা। বলছেন, ‘‘সুব্রত রুদ্রর ‘কাদম্বরী দেবী’ নামে যে বইটি আছে সেখানে রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখার একটা অংশ এই প্রসঙ্গে বেশ মনে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশে বৌদি সম্পর্কটি বেশ মধুর। এমনটি আর কোনও দেশে নেই। মনে পড়ে আমার নতুন বৌঠানের কথা। খুব ভালবাসতুম তাঁকে। তিনিও আমায় খুব ভালবাসতেন। এই ভালবাসায় নতুন বৌঠান বাঙালি মেয়েদের সঙ্গে আমার প্রাণের তার বেঁধে দিয়ে গিয়েছেন। আমার সকল আবদারের একটি স্থান ছিল নতুন বৌঠান।’” সুমনের ফিল্মটি কাদম্বরী দেবীর দৃষ্টিকোণ থেকে। “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাদম্বরীর সম্পর্ক নিয়ে আমার একটা নিজস্ব ধারণা রয়েছে। সেটাই সিনেমাতে ব্যক্ত করব। আমার ফিল্মের ক্যানভাসে পুরো ঠাকুরবাড়িকেই ধরা আছে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরীকে শুধুমাত্র আলাদা করে দেখা সম্ভব নয়। এই সম্পর্কটিতে একই সঙ্গে মাতৃত্ব-বন্ধুত্ব-মিউজ-ভালবাসার সংমিশ্রণ আনার চেষ্টা করছি।”
তবে সুমন নিজে খুব উৎসুক কিউ-য়ের ‘সুপারবৌদি’কে নিয়ে। “আবদার শব্দটি বৌদি-দেওর-য়ের সম্পর্কটিকে একটা অন্য মাত্রা দেয়। জানি না তখনকার দিনে বৌদিবাজি শব্দটি ছিল কি না। আমার মনে হয় বৌদিবাজি ব্যাপারটার মধ্যে লুকিয়ে আছে সুপ্ত যৌন কামনা আর ফ্যান্টাসি। শুনেছি কিউ-য়ের ফিল্মে বৌদিবাজি একদম অন্য ভাবে দেখানো হচ্ছে।”
‘সুপারবৌদি’তে ঋ অভিনয় করেছেন বৌদির ভূমিকায়। বলছেন, “সিনেমায় আমার চরিত্রে দু’টো দিক রয়েছে। এক দিকে আমি পারফেক্ট বৌদি, ভীষণ ফেমিনিন। অন্য দিকে মেয়েদের উপর চার দিকে যা অত্যাচার হচ্ছে, সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে আর অন্য সব মেয়েদের রক্ষা করার চেষ্টা করছি। একটা সময় এসে আমাকে ঠিক করতে হয় আমি কোন ইমেজটা চাই। সিনেমাতে আমাকে অনেক রকমের অ্যাকশন করতে হবে। আপাতত এই সিনেমার ফান্ডিংয়ের জন্য আমরা দরখাস্ত করেছি। সেটা জোগাড় হলে তার পর ফিল্মটা শুরু হবে।”
হিন্দি সিনেমায় বৌদি প্রসঙ্গ এলে উঠে আসে অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ‘কসমে ওয়াদে’-র কথা যেখানে সুমন ভাবী (রাখি) আর রণধীর কপূর (রাজু)-র সম্পর্কের মধ্যে সনাতন স্নেহশীলতার সঙ্গে ছিল ইরোটিক আন্ডারটোন। ‘সিলসিলা’তে শেখর মলহোত্রা (শশী কপূর) আর অমিত মলহোত্রা (অমিতাভ বচ্চন) দুই ভাই। শোভা (জয়া বচ্চন)কে বিয়ে করার ঠিক আগে শেখরের প্লেন ক্র্যাশে মৃত্যু হয়। সম্পর্কে যিনি বৌদি হতেন তাঁকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেন। সুরজ বরজাতিয়ার ‘হম আপকে হ্যায় কৌন’-য়ের দেওর সলমন খান আর রেণুকা সাহানে বৌদির চরিত্রটি বেশ জনপ্রিয় হয়। কিন্তু এই গল্পের ট্যুইস্ট আসে যখন রেণুকার অকালপ্রয়াণে মাধুরী দীক্ষিতকে প্রস্তাব দেওয়া হয় যাতে তিনি তাঁর জামাইবাবুকে বিয়ে করে দিদির বাচ্চার পালিকা মা-এর জায়গা নেন। ‘ইশকিয়া’তে বিদ্যা বালনের চরিত্রটি বেশ সাহসী। স্বামী মারা যাওয়ার খবর রটে যাওয়ার পর বিদ্যার বাড়িতে আসেন নাসিরুদ্দিন শাহ ও আরশাদ ওয়ারসি। তার পর শুরু হয় বিদ্যার সিডাকশন কাহিনি।
তবে ‘বি এ পাস’-এ রাজেশ শর্মার স্ত্রীর ভূমিকায় শিল্পা চলচ্চিত্র জগতের বৌদিদের থেকে আলাদা। এই ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন অলকানন্দা দাশগুপ্ত। বলছেন, “বিদ্যার চরিত্রটি ‘ইশকিয়া’তে বেশ সাহসী ছিল। তবে শিল্পার চরিত্রটি আমাকে চমকে দিয়েছিল। মহিলা বেশ ধুরন্ধর। ছেলেটি তাকে আন্টি বলে ডাকতে গেলে তাকে বাধা দেয়। টাকার লোভে তিনি ‘মাসি’ হয়ে যাননি। ক্ষমতা পাওয়ার আকর্ষণটাই তাঁর বেশি, যে ক্ষমতার জোরে সে অল্পবয়স্ক ছেলেদের অন্ধকার দুনিয়াতে নিয়ে যেত। নিজের ভাগ্যকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করত। এমনকী নিজের মৃত্যু কী ভাবে হবে সেটাও নিজেই ঠিক করেছে সে।”
আগামী দিনে হয়তো এই ক্ষমতা-আকৃষ্ট বৌদিদের নিয়ে নতুন চিত্রনাট্য লেখা হবে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.