নবারুণ ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘কাঙাল মালসাট’ এক অদ্ভুত ভাবনায় এনে ফেলেছে বাঙালিকে। যা ছিল উপন্যাসবেশ কিছু এডিশন কাটানো, তা হল নাটক, আর এখন চলচ্চিত্র, এবং প্রায় গায়ে গায়ে গ্রাফিক নভেলও। উপন্যাস হিসেবে ব্যতিক্রমী ‘কাঙাল মালসাট’ ছবি হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেছবির বাগবুলির অনুকরণে বলতে এক রামধাক্কা। খিস্তি-খেউড়ের সুনামিতোড়ে দর্শকবৃন্দের যে উচ্ছ্বাস, আমোদ দেখলাম তাতে ভরসা জাগছে যে খুব বিচিত্র, ভেবড়ানো বিষয়পত্তরও খুব কায়দা করে পরদায় তুললে তা আমল দেবার জায়গায় এসেছে বাঙালি।
এমনই কায়দা কষেছেন প্রথমে মঞ্চে এবং রুপোলি পরদায় সুমন মুখোপাধ্যায়। মূলত ভাষা, সংলাপ এবং ব্যবহারনির্ভর একটা টেক্সটকে (চিত্রনাট্যকেই টেক্সট ধরলাম) দৃশ্যায়িত করা খুব এলেবেলে কাজ নয় কিন্তু। তার উপর বিষয় যদি হয় রাজনীতির চক্করবাজি, সমাজের ক্রমাগত হড়পাবানে তলিয়ে যাওয়া, কমজাত, অঘর মানুষের উদ্বাহু হয়ে শ্মশাননেত্য। ‘কাঙাল মালসাট’ মানে ভিখিরির চেল্লাইমেল্লাই, নামকরণের কার্যকারণটা এখানেই এসে পড়ে। এ ছবির পটভূমি কলকাতা। এবং অবধারিত ভাবে তার রাজনীতি।
বস্তুত ‘কাঙাল মালসাট’ এই সময়, এই সময়ের এবং কতিপয় দর্শকের রাজনীতিতে গেড়ে বসা এক বিদ্রুপ নকশা। অন্ত্যজ সমাজের লোক না হলেও ছবির কাঙালদের মেজাজমর্জি, রাগক্ষোভ, চালচলন, চালিয়াতি বুঝতে উপরতলার লোকের আর তেমন সমস্যা হয় না। কারণ কী বাম, কী তার উত্তরসূরি জমানার রাজনৈতিক-প্রশাসনিক করণকৌশল অবলীলায় ভিন্ন স্তর, ভিন্ন গোত্রের মানুষদের গায়ে গায়ে এনে ফেলেছে। কাঙালদের মধ্যেও কি কিছুটা কিছুটা নিজেদের মুখ দেখি না আমরা? কাঙালদের খিস্তিতে যে দমফাটা হাসি উতরোতে দেখি তার বড় কারণ এই তথাকথিত অপভাষার দিব্যি উদ্বর্তন হয়েছে উপরতলার সমাজে। নবারুণের রচনা ও সুমনের ছবি বলা যায় এক সামাজিক স্বীকৃতি দিল এই পরিণতিকে।
এই ছবিতে ভদির চরিত্রে এককথায় অসাধারণ, অনবদ্য কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। ওঁর মুড, চাহনি, শরীরের ভাষা আর সংলাপ বলা বলতে গেলে গায়ে কাঁটা ধরিয়ে দেয়। সাধে কি আর দর্শক মনে করছেন কৌশিকই ছবির মেরুদণ্ড। আরেকটা কথা বলে ছবির গঠনগাঠনে যাব। তা হল অনেক জায়গাতেই বিকট হাসির জায়গাতেও কান্না এসেছে আমার। কারণ যে নিষ্ঠুর পরিস্থিতি থেকে এই হাসি উঠে এসেছে তা চাক্ষুষ করাও কঠিন। চিন্তায় মার্ক্সবাদী নবারুণ ভট্টাচার্য প্রায় নিজের বিরুদ্ধে গিয়েই বাম শাসনের অবলুপ্তির একটা আলোছায়া ছবি তুলেছেন লেখায়। যা অনুরূপ নির্মমতায় চলচ্চিত্রায়িত করেছেন সুমন। ছবির শেষ দিকের কিছু দৃশ্য কাটা হলে তার উপসংহার ফস্কে যায় না দর্শকের মন থেকে। যা বলে দেয় যা অমোঘ ভাবে সুদূর ১৮৪৯ সালে বলেছিলেন আলফঁজ কার যে, দ্য মোর থিংস চেঞ্জ দ্য মোর আর দ্য সেম। অর্থাৎ কোনও কিছু যত বদলায় ততই তা যেন আগের মতো হয়ে যায়।
ছবিতে দেখাচ্ছে বাম শাসনের পরিবর্তন হয়েও শহর-রাজ্য-জীবনের সেই এক দশা দেখে কবীর সুমনের গান ‘ঝিনচ্যাক ছাড়া কিছু থাকবে না’ এক অপরূপ বিষাদগীতির মতো শেষ ডেকে আনে ছবিতেও। |
‘কাঙাল মালসাট’কে কাহিনি হিসেবে ধরলে গুলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অজস্র টুকরো দৃশ্যের অভিনব পাস্টিসা ছবিটা। অজস্র চরিত্রের মতো ছিটকে ছিটকে এসে একটা কাহিনির ছায়া তৈরি করে। আর সেই খণ্ডকাহিনি ও খণ্ডচরিত্ররা সরে গেলে দর্শকমনে যা থাকে, তা একটা সময় ও সমাজের ছাপ। যে সময় ও সমাজকে হাড়ে হাড়ে চিনি আমরা। কিন্তু বুঝতে পারি না। ‘কাঙাল মালসাট’ একটা রূপক ও রূপকথার আশ্রয়ে আপাত অসংলগ্ন ঘটনায় একটা কাহিনি আরোপের চেষ্টা করেছে।
সেই কাহিনির প্রধান চরিত্র দণ্ডবায়স (কবীর সুমন) বা দাঁড়কাক। সে এক ভবিষ্যদ্রষ্টা। এবং সে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেমেছে। তার হয়ে মাঠে নেমেছে তার ছেলে ভদি (কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়)। সঙ্গী পেয়েছে বেচামণিকে (কমলিকা বন্দ্যোপাধ্যায়)। যে ভরন্ত যৌবন নিয়ে বরের বিছানায় আছে, বিপ্লবেও আছে। বিপ্লবে নামা কাঙালরা আবার দুই গোষ্ঠীতে বিভক্ত। চোক্তার এবং ফ্যাতাড়ু। ফ্যাতাড়ুরা আবার উড়তেও পারে। উড়তে পারে মানে দরকার মতো অন্য দাঁড়ে উড়ে বসা কিনা এই প্রশ্নটা ওঠে দর্শকমনে।
তিন জম্পেশ ফ্যাতাড়ু, যথাক্রমে মদন (শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়), ডি এস (দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য) এবং কবি চরিত্র পুরন্দর (জয়রাজ ভট্টাচার্য)। স্বয়ং স্ট্যালিন একদিন বাঁধানো ছবি থেকে নেমে এসে বাম নেতাকে কড়কে দেন বিরোধীদের সঙ্গে বোঝাপড়ার নরমপন্থা ধরার জন্য। তখন সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম সমস্যাগুলো উথলে ওঠে। তবে টোটকা যা দিতে পারলেন স্ট্যালিন (সুমন্ত মুখোপাধ্যায়), শেষ অবধি তা কয়েক রাউন্ড নিট ভদ্কা, যা গিলে তাত্ত্বিক নেতা টেবিলের নীচে আশ্রয় নিলেন। এই ভদ্কাটাই কি ক্ষমতার মদোন্মত্ততা?
কাহিনিতে বড় রসচরিত্র হয়েছে পুলিশকর্তা, পুলিশ কর্মীরা। স্বয়ং পুলিশ কমিশনারই (বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী) গলাকাটা। ফ্যাতাড়ুদের হাতে গলা গিয়েছে, পদটা তখনও আছে। শেষে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়তে বোমাবাজিতে পেল শহরকে। স্প্লিট স্ক্রিনে অসংখ্য দৃশ্যে যুগপতন চমৎকার ধরা পড়ল। পরিবর্তন যা এল, তাতে পরিবর্তনটা কোথায় সে জন্য হলে বসে দেখাই ভাল। কারণ উষসী চক্রবর্তীর যৌনকর্মী চরিত্র কালী এবং জোজোর অভিনয়ে ইতিহাসের চরিত্র বেগম জনসনকে দেখাটা এই জটিল ছবির দু’টি নির্মল আনন্দের জায়গা।
‘কাঙাল মালসাট’ ছবি সুমন পরিচালিত নাটক ‘রাজা লিয়র’য়ের মতো এক বহুজন গুণাণ্বিত প্রয়াস। তবু কবীর সুমন, কৌশিক, শান্তিলাল ও কমলিকার কাজ চরিত্রগুণেই হয়তো ভারী দাঁড়ায়। এর আগে ওঁর অনেক ভাল কাজ দেখে থাকলেও এ ছবিতে অভীক মুখোপাধ্যায়ের সিনেমাটোগ্রাফি আমাকে আশার অতীত মুগ্ধ করেছে। চোস্ত সম্পাদনা অর্ঘ্যকমল মিত্রের। ময়ূখ ভৌমিকের সুরারোপ এবং সুকান্ত মজুমদারের ধ্বনি পরিকল্পনা শাণিত অস্ত্র ছবির।
ছায়াছবির সমালোচনায় প্রযোজকের নামোল্লেখ কদাচ করেছি অ্যাদ্দিন। আজ করছি। কারণ ‘কাঙাল মালসাট’-য়ের মতো একটা ছবিতে পয়সা লাগানোর মতো বুকের পাটা আর কে দেখাত আমার জানা নেই। ওঁর ইচ্ছে না হলে এমন একটা ছকভাঙা, বাজারের ব্যাকরণ না-মানা, কিছুটা মাথা গুবলেট করা ছবির পেছনে কে টাকা লাগাত ভেবে পাচ্ছি না। জ্যঁ লুক গোদার, তাঁর সব ছবির পেছনে নিজের ঘর থেকেও কিছু টাকা লাগাতেন, কারণ তাঁর সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার আর্থিক দায় কেবল প্রযোজকের ওপর চাপাতে চান না। সুমনের সৌভাগ্য তাঁর একজন পবন কানোরিয়া আছেন।
শেষে আর একটা কথা। ডিসকোর্সধর্মী ছবিটা রূপকের আড়ালে থেকে বহু দর্শকের কাছে টান হারিয়ে ফেলে। সংলাপের মারকাটারি ঠিক আছে, কিন্তু এত খোলস ছাড়িয়ে ছবির মানে করা কি আমজনতার কাজ? এই প্রশ্নটাও উঠছে। বহুজনায় যে বার্তা তা বুঝল বটে কেউ কেউ। সুমন কি বলতে পারছেন তাতে বয়ে গেল?
ছবি হিসেবে যে খুব উঁচু করে দেখতে পারব না তার কারণ ‘কাঙাল মালসাট’ সিনেমা তো প্রায় নাটকের ব্যাগেজ বহন করে চলে। মঞ্চ থেকে যে সংলাপ আসে, তাকে আমরা মনের রঙে রাঙিয়ে অনেক দৃশ্য দেখতে পাই। সিনেমা কিন্তু সেই সংলাপকে দৃশ্য করে তোলে, কল্পনার জমি কম রেখে। এটা সিনেমা ও নাটকের চিরকেলে সংঘাত। এর নানা মুক্তির রাস্তা অনেকেই বের করেছেন নানা ধরনের। যে কারণে কোজিন্তসেভের ‘হ্যামলেট’ সিনেমা হিসেবে আর সব হ্যামলেটকে টপকে যায়। কিংবা ওই কোজিন্তসেভেরই ‘কিং লিয়র’। নাটক থেকে সিনেমায় আসতে গেলে এটাই বড় চ্যালেঞ্জ। সুমন তো স্ট্যানলি কুবরিকের ‘আ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ’-এর ভক্ত, যেখানে উপন্যাস ও সংলাপকে কী ভাবে ছবিতে চালান করা হয়েছে আমরা দেখতে পাই। সে-ও এক চ্যালেঞ্জ আমার কাছে।
আর একটা কথা, যা আগেও বলেছি। এক-দেড় লক্ষ টাকার নাটক প্রযোজনার থেকে এক-দেড় কোটি টাকার সিনেমা প্রযোজনা কিন্তু অন্য কথা বলে। হয়তো একটা সরলতাও দাবি করে। সুমনের জন্যই বলব, আর একটু সরলতা কি আনিয়ে নেওয়া যেত না ছবিতে? এত দর্শক ছবির গল্পটাকে ভুল বুঝবেন কেন?
সে কারণেই যত মার্কস দেব ভেবেছিলাম, দিতে পারছি না। অনেকের হয়ে কথা বলছি বলে নিজের অনুভূতিকে একটু সামলে নিলাম। দিতে পারতাম দশে আট। দিচ্ছি সাত। |