|
|
|
|
সোহিনী একেবারে রকস্টার
সোহিনী সেনগুপ্ত বিয়ে করে ফেললেন। তিন মাসের প্রেমে। সবার অগোচরে। লিখছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
কনের পরনে লাল বেনারসি। বরের গায়ে কালচে মেরুন রঙের টি-শার্ট। আর দু’জনের মুখেই কান এঁটো করা হাসি।
২ অগস্ট বিয়ে করেছেন সোহিনী সেনগুপ্ত। পাত্রের নাম সপ্তর্ষি মৌলিক। প্রেম করে বিয়ে। চেয়েছিলেন লিভ-ইন করতে। কিন্তু বাদ সাধলেন পাত্র নিজেই। বললেন বিয়ে নামক ইনস্টিটিউশনে বিশ্বাসী তিনি। আর তাই চান যে লিভ-ইন নয়, সোজা বিয়ে করতে। শুধু পাঞ্জাবিটা পরতে একটু অসুবিধে তাঁর। তাই মেরুন রংয়ের টি-শার্ট পরেই মালাবদল করলেন।
নতুন বিয়ের গন্ধ এখনও গা থেকে যায়নি সোহিনীর। হাতে শাঁখা-পলা। সিঁথিতে সিঁদুর। কী ভাবে প্রেমে পড়লেন তিনি? জিজ্ঞেস করতেই হেসে বলেন, “সপ্তর্ষির সঙ্গে নান্দীকারে দেখা। ‘নাচনী’ নাটকটা করার সময় সপ্তর্ষির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। জীবনে আমি প্ল্যান করে চলিনি। জানতাম যে প্রেম এলে সেটা এমনিতেই আসবে। আর সেটাই হল,” বলছেন সোহিনী।
বছর দুই আগে সপ্তর্ষি নান্দীকারে আসেন। “ওর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি যে ও অন্যদের থেকে অনেকটাই আলাদা। শান্ত কর্মী যাকে বলে। আমি নিজেও সে রকম। এমনিতেই সপ্তর্ষি বেশ কম কথা বলে। ও হল খেটে খাওয়া মানুষ। এটা একটা বিরল গুণ। খুব কম মানুষের মধ্যে এটা দেখেছি,” বলছেন তিনি।
তবে যেটা হয়তো ভাবতেই পারেননি, সেটা হল যে ভাবে সপ্তর্ষি এসে সোহিনীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক এসে বলেন যে তিনি তাঁর প্রেমে পড়েছেন। আর তার পরের লাইনটাই হল বিয়ে করবে? সোহিনী উত্তরে শুধু বলেন, “মানে?” তখনও দু’জন দু’জনকে তুমি বলে সম্বোধন করতেন। সে দিনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে সপ্তর্ষিকে জিজ্ঞেস করা হয় কোথা থেকে এতটা আত্মবিশ্বাস পেলেন
এ ভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিতে? মনে হয়নি যে সোহিনী রেগে যেতে পারেন? বা নান্দীকারে এই সব কথা জানাজানি হয়ে গেলে হয়তো অসুবিধে হতে পারে। “না,’’ বলছেন সপ্তর্ষি। “খানিকটা আন্দাজ করেছিলাম যে ও রেগে যাবে না।” সোহিনী তাঁর সঙ্গে জুড়ে দিয়ে বলেন, “আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার পরের দিন আমার বাবা-মা আর ওর বাবা-মা’কে গিয়ে সব জানিয়ে দিই। আমি বলেছিলাম লিভ-ইন করার কথা। কিন্তু সপ্তর্ষি বলে: ‘আমি বিয়েতে বিশ্বাস করি। লিভ-ইন নয়, একদম বিয়েই করব। মে-র শেষে যাকে বলে একদম দড়াম করে প্রেমে পড়লাম।” |
|
তা, চিঠি লেখা, ঘনঘন এসএমএস পাঠানো এ সব করেছেন নাকি? “না, এ সব আমার একদম পছন্দ নয়। কাজের জন্য অনেক ক্ষেত্রে দেখা হয়ে যেত। আবার অনেক সময় ইচ্ছে করে রিহার্সাল ফেলতাম যাতে দেখা করা যায়,” সপ্তর্ষি জানান। সোহিনী ধরে ফেলতেন না সেটা? “হ্যাঁ, ধরতে পারলেও আপত্তি তো করেনি,” মৃদু হেসে বলেন তিনি।
যেটা সব থেকে সুবিধে হয়েছে, তা হল রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত সপ্তর্ষিকে বেশ পছন্দ করেন। “দিস ইজ দ্য ওনলি টাইম হোয়েন মাই ফাদার হ্যাজ রিয়েলি লাইকড সামবডি ফর মি। হ্যাঁ, বয়সের পার্থক্য রয়েছে। তবে সপ্তর্ষি আমার থেকে অনেক বেশি স্টেডি। চিন্তাভাবনায় অনেক বেশি পরিণত। এই একমাত্র ক্ষেত্রে বাবা নির্দ্বিধায় হ্যাঁ বলেছিলেন। তা না হলে আমার বেশ অসুবিধে হত,” সোহিনী জানান।
রুদ্রপ্রসাদকে সপ্তর্ষির সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করাতে উনি বলেন, “আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন এই মেয়েটি কেমন, তখন আমি তার লম্বা চুল, টিকোলো নাক বা মিষ্টি হাসি নিয়ে আলাদা ভাবে বলতে পারি না। বা একটি ছেলের বাইসেপের মাপ কত সেটাও বলতে পারি না। আসলে আমি একটি মানুষকে আলাদা করে বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখতে শিখিনি। সামগ্রিক ভাবেই আমার সপ্তর্ষিকে পছন্দ।”
সোহিনীকে অবশ্য সপ্তর্ষির আরও একটা গুণ মুগ্ধ করেছে। “ভাল পরিবারের ছেলে ও। বাড়িতে সবাই বেশ পড়াশোনা নিয়ে থেকেছেন। ওর পরিবারের সবাই আমাকে খুব ভালবাসে। মানুষ হিসেবে ওরা আমাকে নিয়ে বেশ গর্বিত। সেটা আমার ভাল লাগে। একটা সম্পর্ক তৈরি হতে গেলে প্রথম প্রয়োজন দু’জন দু’জনকে সম্মান করা। আমাদের মধ্যে সেটাই হয়েছিল। সেলিব্রিটি আইডেন্টিটি নয়। মানুষ হিসেবে ও আমাকে সম্মান করে। আমিও তাই। তার পর প্রেম।”
সপ্তর্ষির ভাষায় সোহিনী একদম রকস্টার। “কিছু মানুষ আছে যারা বেড়া ভেঙে এগোতে পারে। সোহিনী সে রকম। ওর আর আমার মধ্যে একটা জেনারেশনের পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু সেই পার্থক্যটা বুঝতে পারি না। ও কী সুন্দর কুড়ি বছরের একটা ছেলের সঙ্গে আড্ডা মারতে পারে। গিটার বাজিয়ে গান গেয়ে এনজয় করতে পারে। আবার বয়স্ক একজনের সঙ্গেও মিশতে পারে বেশ ভালো ভাবে। ওকে দেখে আমার মনে হয় যে একদম রকস্টার।”
অনেক ক্ষেত্রে সৃজনশীল মানুষের পছন্দের অমিল থাকে। হয়তো কারও পছন্দ ক্লাসিকাল মিউজিক। কেউ ভালবাসেন গজল। কেউ গদার্দ-এর ছবি বলতে অজ্ঞান। কেউ বা কিম কি ডুক। এ রকম কোনও অমিল নেই তাঁদের মধ্যে? “না, ওই সব মিল গরমিলের প্রসঙ্গে না গিয়ে বরং আমি বলি অন্য একটা কথা। সোহিনী বেশ সহজেই সবাইকে ভালবাসতে পারে। আমি সেটা পারি না,” বলছেন সপ্তর্ষি। চাইবেন কি অভ্যেসটা পালটাতে? “না। এটা তো একটা বড় গুণ। কেন চাইব ও পালটে যাক?” পালটা জবাব দেন তিনি।
সপ্তর্ষির ঘাড় অবধি লম্বা চুলও নাকি সোহিনীর বেশ পছন্দ। বলছেন, “বাবা-মা চুলটা কাটতে বলেছেন। সোহিনী বলেনি। মাঝে মাঝে চুলটা খুলে রাখি। কখনও কখনও ঝুঁটি বাঁধি।” |
|
বিয়ের পর সোহিনী পদবি পালটাচ্ছেন না। সপ্তর্ষির মতে, “আমাকে কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে শুধু সপ্তর্ষি বলি। আমার মনে হয় টাইটেল জিনিসটা বেশ বোকা বোকা। সেটাতে কিছু এসে যায় না।”
বিয়ের পরেও শ্বশুর-শাশুড়িকে স্যার আর ম্যাম বলেই সম্বোধন করেন সপ্তর্ষি। সোহিনী শ্বশুর-শাশুড়িকে ডাকেন বাবাই আর মাম্মি বলে। তাঁরা থাকবেন সল্টলেক, উত্তরপাড়া (সপ্তর্ষির বাড়ি) আর বিবেকানন্দ রোডের বাড়ি মিলিয়ে। শেষের ঠিকানাটি রুদ্রপ্রসাদ আর স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর বাড়ি। ওখানেই রেজিস্ট্রি হয়েছিল তাঁদের। “মালাবদল, সিঁদুর দান, আংটিবদল...এই সবই হয়েছিল। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়রা ছিলেন। শিবু ছিল চিফ পান্ডা। পরিচালক নন্দিতা রায় ছিলেন। আর ছিলেন ‘ভাল থেকো’র পরিচালক গৌতম হালদার। উনি আমাকে ছোট থেকেই দেখেছেন,” বলছেন সোহিনী।
যেখানে চারপাশে এত ভঙ্গুর সম্পর্ক, সেখানে এমন কিছু কী রয়েছে যা তাঁরা করবেন না? সপ্তর্ষি জানান, “এটুকু বুঝেছি যে ওর দিকে কোনও কিছু খারাপ হলে আমি যেন সেটা মেনে নিতে পারি। আর আমার ক্ষেত্রেও যেন ও সেটাই করতে পারে।”
অভিনেত্রী সোহিনীকে নিশ্চয়ই ভাল লাগে... কথা শেষ হতে না হতেই সপ্তর্ষি বলেন, “শুধু ভালই লাগে না, ব্যাপক লাগে। ওর সব চেয়ে বড় গুণ হল ও ন্যাচারাল অভিনয় করে। সাবলীল লাগে ওকে। থিয়েটারে স্বাভাবিক ভাবে একটু চড়া অভিনয় লাগে। কিন্তু বায়াসড না হয়েই বলছি যে ও স্টেজে যে ভাবে অভিনয় করে, সেখানে ওকে ন্যাচারালি লাউড লাগে না। ওর অনেক নাটকই আমি দেখিনি। যেগুলো দেখেছি, তার মধ্যে ‘নাচনী’তে ওর অভিনয় আমার ভাল লেগেছে।” ‘ইচ্ছে’তে যে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি, বাস্তবে নিশ্চয়ই চাইবেন না সোহিনীকে ওই রূপে কোনও দিন দেখতে। “ওটা তো একটা চরিত্র। ও বাস্তবে একদমই ও রকম রিঅ্যাক্ট করে না,” সপ্তর্ষি বলেন।
নিজের কেরিয়ার নিয়ে কী ভাবছেন তিনি? “আপাতত ‘নান্দীকার’-এ কাজ করতে চাই। স্যারের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। আমি নিজের যোগ্যতা দিয়েই সব কিছু অর্জন করতে,” বললেন সপ্তর্ষি।
এই দম্পতির হানিমুনে যাওয়ার সময় নেই। মাতৃত্ব নিয়ে মোটেও প্ল্যান করছেন না এখনই। আপাতত জমিয়ে সংসার করছেন দু’জনে। সদ্য ‘অলীক সুখ’-এ অভিনয় করেছেন সোহিনী। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে চলতে গিয়ে সুখের পরিভাষাটা কী বলে তাঁর মনে হয়? “সুখ মানে সত্যি। জীবনে চলার পথে এটাই শিখেছি। সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এই সততাটাই রাখতে চাই,” উত্তর সোহিনীর।
পুনশ্চ: সপ্তর্ষির ভাষায় সোহিনীকে তাঁর দেওয়া সব চেয়ে বড় গিফ্ট হল তাঁর হৃদয়! তা শুনে সোহিনীর হেসে উত্তর: ‘উফফ্!’ |
|
|
|
|
|