অবরোধে অচল বিদ্যুৎকেন্দ্র, পাল্টা ধরপাকড় |
কিশোর সাহা • শিলিগুড়ি
রবিন রাই • দার্জিলিং
|
অনির্দিষ্ট কালের বনধ শুরু হওয়ার প্রথম দিনেই আরও অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠার আশঙ্কা দেখাচ্ছে পাহাড়। এক দিকে রাম্মাম এলাকায় দু’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেয় মোর্চা। সেই ঘটনায় প্রকাশ গুরুঙ্গ নামে এক মোর্চা নেতা তথা জিটিএ সদস্যকে পুলিশ পাকড়াও করলে মশাল হাতে দার্জিলিং থানা ঘেরাও করেন মোর্চা সদস্যরা। অন্য দিকে, দিল্লিতে ধর্নার পাশাপাশি রোশন গিরিরা দেখা করেছেন শরদ পওয়ার, যশোবন্ত সিংহের মতো একাধিক সর্বভারতীয় নেতার সঙ্গেও।
কিন্তু এই অবস্থাতেও রাজ্য যে নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকবে, তা শনিবার মহাকরণে স্পষ্ট করে দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “আমরা ইতিমধ্যেই কড়া ব্যবস্থা নিয়েছি।” এ দিনই পাহাড়ে এসে পৌঁছেছে তিন কোম্পানি সিআরপি। আরও দুই কোম্পানি শীঘ্রই এসে যাবে। রাম্মামের ঘটনায় মোট ৩২ জনকে গ্রেফতার করে প্রশাসনও স্পষ্ট করে দিয়েছে, শক্ত হাতেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা হবে। এ দিনই কেন্দ্রীয় সরকারও ইঙ্গিত দিয়েছে, এই সঙ্কটে তারা রাজ্য সরকারেরই পাশে থাকবে। |
|
গড়িয়ে প্রতিবাদ। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ প্রমাণে
চকবাজার পর্যন্ত দু’কিলোমিটার পথে অভিনব কর্মসূচি যুব মোর্চার। ছবি: রবিন রাই |
রাম্মামে দু’টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ বন্ধ করে অবরোধই শুধু নয়, পাহাড় আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বিকেলে মোর্চা সমর্থক মঙ্গল সিংহ রাজপুতের (৩৫) মৃত্যুর খবর চাউর হওয়ার পরে। গত ৩০ জুলাই এই মোর্চা সমর্থক কালিম্পঙের ডম্বর চকে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে বিক্ষোভ চলাকালীন গায়ে আগুন দেন। তাঁকে প্রথমে কালিম্পঙের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরে নিয়ে যাওয়া হয় শিলিগুড়িতে। এ দিন বিকেলে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়। তার পরেই পাহাড়ে মোর্চা সমর্থকদের ক্ষোভ তুঙ্গে ওঠে। খবর জানার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ ফেসবুকের মাধ্যমে বার্তা দেন: মঙ্গলের জন্য শোক পালন করতে হবে পাহাড়বাসীদের।
সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে হবে সকলকে। পাশাপাশি, গুরুঙ্গ এটাও অভিযোগ করেছেন, “পাহাড়ে অশান্তি তৈরির জন্য চক্রান্ত করছে রাজ্য সরকার। সিআরপি মোতায়েন করেছে। আমরা রাজ্য সরকারের সঙ্গে কোনও আলোচনায় এখন যাব না। কেন্দ্র ডাকলে অবশ্যই যাব। গোর্খাল্যান্ডের দাবি নিয়ে যা কথাবার্তা হবে সব কেন্দ্রের সঙ্গে।”
মোর্চার অন্দরের খবর, ওই ঘটনাকে সামনে রেখে পাহাড়ে আন্দোলনকে আরও জোরদার করার প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন গুরুঙ্গ। মোর্চার লক্ষ্য, এক দিকে, দিল্লিতে যন্তর-মন্তরে অবস্থান বাড়িয়ে কেন্দ্রের উপরে চাপ বাড়ানো হবে। দিল্লির নানা স্তরের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে সমাধানসূত্র খোঁজার চেষ্টাও হবে। পাশাপাশি, পাহাড়ে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়িয়ে রাজ্যকে আরও বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা হবে। মোর্চা সূত্রেই জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যেই পাহাড়ের তিন মহকুমা গোর্খাল্যান্ড পার্সোনেল (জিএলপি) সদস্যদের মধ্যে বাছাই করা অন্তত ২০০ জন দার্জিলিং সদরে পৌঁছেছেন। |
|
এর মধ্যেই পুলিশের কাছে খবর আসে, পুলিশ-সিআরপির পথ আটকাতে রাস্তা কাটার ছকও কষছেন মোর্চার কট্টরপন্থীদের একাংশ। তবে পুলিশের একটি অংশ মনে করছে, লালগড়ের মতো জঙ্গলমহলের এলাকায় যে ভাবে রাস্তা কেটে আন্দোলন করেছিলেন এলাকাবাসীরা, তেমনটা পাহাড়ে করা কঠিন। কারণ, পাহাড়ে একটা রাস্তা কেটে দিলে দ্বিতীয় রাস্তা ব্যবহার করার উপায় থাকে না। ফলে, রাস্তা কাটলে যেমন সিআরপি পাহাড়ে ঢুকতে পারবে না, তেমনই পাহাড়বাসীরাও কোনও প্রয়োজনে সমতলে নামতে পারবেন না। তাই, এ নিয়ে মোর্চার মধ্যেই মতভেদ
রয়েছে বলে খবর। রাজ্য পুলিশের আইজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা, যিনি মাস দু’য়েক আগেও উত্তরবঙ্গের দায়িত্ব ছিলেন, তিনি বর্তমানে দার্জিলিঙে রয়েছেন। তাঁর কথায়, “পাহাড়ে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে রাজ্য সরকার সব রকম চেষ্টা করছে। কোনও অশান্তির চেষ্টা বরদাস্ত করা হবে না।”
গুরুঙ্গকে অবশ্য দিনভর রাস্তায় দেখা যায়নি। তাঁর স্ত্রী আশা গুরুঙ্গের নেতৃত্বে পাহাড়ের মিটিং-মিছিল হয়েছে। নারী মোর্চার সভানেত্রী আশা যদিও দাবি করেছেন, “আমরা কোনও হিংসার রাস্তায় যাব না। নানা জায়গায় হিংসার ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের উপরে দায় চাপানোর চেষ্টা হবে বলে আশঙ্কা করছি। কিন্তু আমরা শান্তিপূর্ণ ভাবে আন্দোলন করে যাব।” |
|
|
কালিম্পঙের ডম্বর চকে
নারী মোর্চা কর্মী সমর্থকদের আন্দোলন। |
দলের কর্মীদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে
দার্জিলিং থানা
ঘেরাও মোর্চা সমর্থকদের। |
শনিবার রবিন রাইয়ের তোলা ছবি। |
|
আশা শান্তির কথা বললেও মোর্চার বিরুদ্ধে হিংসাত্মক ঘটনার অভিযোগ কিন্তু ক্রমশ বাড়ছে। শুক্রবার গভীর রাতে বিজনবাড়ি এলাকার একটি গ্রাম পঞ্চায়েত অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রত্যন্ত এলাকায় থাকা এই পঞ্চায়েত অফিসে দমকল পৌঁছনোর আগেই সেখানকার অধিকাংশ নথিপত্র, আসবাব ছাই হয়ে যায়। শনিবার সকালে রিমবিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে ঢুকে সেখানকার সব ইঞ্জিনিয়ার ও কর্মীকে বাইরে বার করে কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই সময়ে লাগোয়া লোধামার নিপ্পন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের উৎপাদনও বন্ধ করে দেন বন্ধ সমর্থকেরা। সিআরপি গেলেও অবরোধ ওঠেনি। বরং অবরোধে নেতৃত্ব দেওয়া মোর্চা নেতা প্রকাশ গুরুঙ্গকে থানায় নিয়ে যাওয়ায় সেখানেও গোলমালের আশঙ্কা বাড়ে। মশাল হাতে দার্জিলিং থানা ঘেরাও করেন বহু মোর্চা সমর্থক। এই পরিস্থিতিতে তখন পুলিশ প্রকাশকে গ্রেফতার করেনি। ফলে তখনকার মতো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। কিন্তু পরে ওই মোর্চা নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। রাম্মামের এই দুই বিদ্যুৎকেন্দ্রে অবরোধের অভিযোগে রাতের মধ্যে মোট ৩২ জন মোর্চা কর্মী-সমর্থককে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ সূত্রের খবর, এ দিন বিকেলে মিরিকের পূর্ত দফতরের একটি বাংলোয় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত পূর্ত দফতরের কর্মীরা তৎপর থাকায় তা বড় আকার নেয়নি।
অনির্দিষ্ট কালের বনধ মোকাবিলায় পাহাড়ে আগেই বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। রাজ্যের তরফে ৫ কোম্পানি সিআরপি চাওয়া হয়েছিল কেন্দ্রের কাছে। কিন্তু ২ কোম্পানি সিআরপি অসমে বড়োল্যান্ডের দাবিতে রেল অবরোধে আটকে ফিরে গিয়েছেন। এ দিন সকালে ৩ কোম্পানি সিআরপি পাহাড়ে পৌঁছেছে। যার মধ্যে ১ কোম্পানি মহিলা সিআরপি রয়েছে। তবে সিআরপি ক্যাম্পে গিয়ে তৈরি হয়ে রাস্তায় নামার আগেই পাহাড়ের পথে নামে মোর্চা। |
বনধে সুকনার একটি স্কুল
থেকে হেঁটেই ফিরছে ছাত্রীরা। |
আত্মঘাতী মঙ্গল সিংহ রাজপুতের
শোকার্ত পরিজনেরা।
শিলিগুড়িতে। |
বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি। |
|
এ দিন দুপুরে মোর্চার যুব সংগঠনের ২৫ জন খালি গায়ে রাস্তায় গড়িয়ে প্রায় ২ কিলোমিটার পরিক্রমা করে গোর্খাল্যান্ডের দাবি তোলেন। তাঁরা স্লোগান ছিল, ‘সিআরপি গো ব্যাক’। সেখানে দু’জন অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। যুব মোর্চার সহ-সভাপতি সঞ্জয় ঠাকুরি বলেন, “জামা খুলে রাস্তা গড়িয়ে আমাদের জেদ দেখালাম। আগামী দিনে আরও কড়া নমুনা দেখানো হবে।” তবে সিকিম গামী ৩১-এ জাতীয় সড়ক ছিল প্রায় স্বাভাবিক। সেখানে প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়। যদিও সিকিমে যাতায়াতকারী গাড়ির সংখ্যা ছিল অনেক কম।
দিল্লির যন্তর-মন্তরেও এ দিন ধর্নায় বসেন মোর্চা নেতা রোশন গিরি, কালিম্পঙের বিধায়ক হরকা বাহাদুর ছেত্রী, দার্জিলিঙের বিধায়ক তিলক দেওয়ান, কার্শিয়াঙের বিধায়ক রোহিত শর্মা-সহ একাধিক মোর্চা নেতা। পাশাপাশি তাঁরা কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রী তথা এনসিপি নেতা শরদ পওয়ার এবং দার্জিলিঙের সাংসদ যশোবন্ত সিংহের সঙ্গেও দেখা করেছেন। শনিবার টেলিফোনে রোশন বলেন, “পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবি সম্পর্কে পওয়ারকে বিস্তারিত জানিয়েছি। উনি দিল্লিতে বিভিন্ন দলের নেতাদের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন।” আজ রবিবার দিল্লিতে সি পি জোশী-সহ কংগ্রেসের বেশ কিছু শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করতে চাইছে মোর্চা প্রতিনিধি দল। তবে এখনও কোন নেতার সঙ্গে দেখা করা হবে, সে বিষয়ে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানা গিয়েছে।
|
বৃহস্পতিবার |
রাত ১২টা |
বিজনবাড়িতে পঞ্চায়েত দফতরে আগুন। |
শুক্রবার |
ভোর ৫টা |
রাম্মাম ও নিপ্পন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে কর্মীদের বার করে অবরোধ। |
বিকেল ৩টে |
পুলিশ এক মোর্চা নেতাকে গ্রেফতার করলে দার্জিলিং থানা ঘেরাও শুরু। |
বিকেল ৪টে |
মিরিকে পূর্ত দফতরের বাংলোয় আগুন। নেভালেন কর্মীরা। |
বিকেল সাড়ে ৫টা |
মৃত্যু অগ্নিদগ্ধ মোর্চা সমর্থক মঙ্গল সিংহ রাজপুতের। |
|
পুরনো খবর: বাহিনী আসার আগেই পুড়ল বাংলো-ফাঁড়ি, জখম পুলিশও |
|