|
|
|
|
বাহিনী আসার আগেই পুড়ল বাংলো-ফাঁড়ি, জখম পুলিশও |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
কেন্দ্রীয় বাহিনী পা রাখার আগেই আগুন জ্বলে উঠল পাহাড়ে।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে প্রায় একই সময়ে চার জায়গায় আগুন লাগানো হল। আক্রান্ত হলেন পুলিশকর্মীরা। এক জনকে মারধরের পরে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ। শনিবার থেকে যে অনির্দিষ্ট কালের বনধ শুরু হতে চলেছে, তার আগে এই ঘটনাকে ‘অশান্তির প্রস্তাবনা’ বলে ব্যাখ্যা করেছে কোনও কোনও মহল। অনেকেরই আশঙ্কা, সিআরপিএফ পাহাড়ে পৌঁছনোর পরে পরিস্থিতি না শেষ পর্যন্ত ১৯৮৭ সালের মতো অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে! রাজ্য প্রশাসনের সাফ কথা, আন্দোলন না থামালে আলোচনা নয়। বরং কঠোর হাতে সামলানো হবে পরিস্থিতি। অন্য দিকে, আলোচনার উপায় খুঁজতেই এ দিন রোশন গিরির নেতৃত্বে দিল্লি গিয়েছে মোর্চার প্রতিনিধিদল। এ দিনই আবার মুম্বই বিমানবন্দরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে। বাহিনীর বিলম্ব নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে নিজের ক্ষোভ জানিয়েছেন মমতা। বস্তুত, যে বাহিনীর সকালেই পাহাড়ে আসার কথা ছিল, অবরোধে আটকে পড়ে রাত পর্যন্ত তারা পৌঁছতে পারেনি।
কী ঘটেছে বৃহস্পতিবার রাতে? |
|
দার্জিলিং হাসপাতালে জখম পুলিশকর্মী বীরমন বরৈলি। ছবি: রবিন রাই। |
রাত সাড়ে ১১টা থেকে পৌনে ১২টার মধ্যে চার জায়গায় আগুন লাগানো হয়। রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ দার্জিলিং থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে তাকদায় নতুন পর্যটন বাংলোয় আগুন দেওয়া হয়। গত বছর অগস্টে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে ওই বনবাংলোটি তৈরি হয়। ওই সময়েই রিমবিকের বন দফতরের রেঞ্জ অফিস এবং লাগোয়া বাংলোতেও আগুন ধরানো হয়। প্রায় একই সময়ে অভিযোগ জমা দেওয়ার অছিলায় মিরিকের পোখরিয়াবংয়ের পুলিশ ক্যাম্পে ঢুকে পাহারায় থাকা পুলিশকর্মীদের মারধর করে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয় কয়েক জন দুষ্কৃতী। দুই পুলিশকর্মী বাধা দিলে তাঁদের বেধড়ক মারধর করা হয়। এক পুলিশকর্মী ধারালো অস্ত্রে জখম হয়ে কোনও মতে পালান। অন্য জনকে জখম অবস্থায় জলন্ত ক্যাম্পে রেখেই পালায় দুষ্কৃতীরা। বীরমন বরৈলি নামে ওই জখম ও দগ্ধ পুলিশকর্মী পরে কোনও মতে ক্যাম্পের বাইরে আসেন। তিনি আপাতত দার্জিলিং জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অন্য আহত পুলিশকর্মী অম্বর থাপাকে চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ দিনই ভোরে লেবঙের কাছে সরোজ তামাং নামে এক যুবকের দেহ মিলেছে। তিনি মোর্চার নেতা।
এই ঘটনায় দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মোর্চার দাবি, ধৃত দু’জন তৃণমূল সমর্থক। তবে তৃণমূল অস্বীকার করেছে।
অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবাল জানিয়েছেন, প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, এরা সকলেই মোর্চার সদস্য। ধৃতদের জেরা করে জানা গিয়েছে, চার জায়গায় আগুন লাগাতে অন্তত ৪০ জন জড়ো হয়েছিল। একযোগে হামলা চালানোরই ছক কষা হয়েছিল। এই ঘটনার পরে রাজ্য সরকারের তরফে মোর্চাকে জানিয়ে দেওয়া হয়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সন্দেহভাজনদের চিহ্নিত করে কড়া ব্যবস্থা নেবে পুলিশ। একই সঙ্গে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব জানিয়ে দিয়েছেন, মোর্চা আন্দোলন প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত রাজ্য তাদের সঙ্গে কোনও আলোচনায় যাওয়ার কথা ভাববে না। গৌতমবাবুর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী পাহাড়ের উন্নয়নে বিঘ্ন বরদাস্ত করবেন না। জিটিএ নিয়ে কথা হতে পারে। কিন্তু আন্দোলন প্রত্যাহার না হলে আলোচনার প্রশ্নই নেই।”
মোর্চা অবশ্য তাদের সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ খারিজ করে জানিয়েছে, এ সবই চক্রান্ত। তাদের ভাবমূর্তিতে কালি লাগাতেই এ সব ঘটানো হচ্ছে। মোর্চার অভিযোগের আঙুল তৃণমূল এবং সুবাস ঘিসিংয়ের জিএনএলএফের দিকে। এ প্রসঙ্গে মোর্চা নেতা রোশন গিরি বলেন, “আমাদের কেউ হামলায় যুক্ত নন। পুলিশ তদন্ত করে ব্যবস্থা নিক। যাঁদের আমাদের সমর্থক বলা হচ্ছে, তাঁরা দলের কেউ নন।” |
|
শিলিগুড়িতে গৌতম দেবের সঙ্গে মুকুল রায়।—নিজস্ব চিত্র |
বৃহস্পতিবারের ঘটনায় পাহাড়ের রাজনীতিতে কিছুটা বিপাকে পড়লেও মোর্চার একাংশ অবশ্য রাজ্যের উপরে চাপ বাড়াতে আগ্রাসী পদক্ষেপের পথেই হাঁটতে চান। একই সঙ্গে কেন্দ্রের উপরেও চাপ বাড়াতে চান তাঁরা। সে জন্য শুক্রবার বিকেলে রোশন গিরির নেতৃত্বে ৬ সদস্যের মোর্চা প্রতিনিধিদল নয়াদিল্লি গিয়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন, ‘নাউ অর নেভার’ এই স্লোগান তুলে শনিবার থেকে রাজধানীর যন্তর-মন্তরে বিক্ষোভ দেখাবেন তাঁরা। এখান থেকে প্রশ্ন তোলা হবে, তেলেঙ্গানা হলে গোর্খাল্যান্ড নয় কেন?
চাপ বাড়ানোর কৌশলের পাশাপাশি আলোচনায় বসে আপাতত বনধ তোলার উপায় খুঁজতে মনমোহন সিংহ সরকারের একাধিক শীর্ষ মন্ত্রী ও কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করার পরিকল্পনা রয়েছে মোর্চা নেতাদের। যে বিমানে মোর্চা নেতারা এ দিন দিল্লি যান, ঘটনাচক্রে, সেই বিমানেই শিলিগুড়ি থেকে দিল্লি যান কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দীপা দাশমুন্সিও। অতীতে মোর্চা নেতাদের দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন দীপা। তিনি এ দিন বলেন, “আমার বিমানের টিকিট আগেই কাটা ছিল।” দিল্লি মোর্চাকে উস্কানি দিচ্ছে বলে মমতার অভিযোগ সম্পর্কে দীপার বক্তব্য, “আমরা কোনও উস্কানি দিচ্ছি না। যে রাজ্য সরকার বলেছিল পাহাড় হাসছে, তাদেরই এখন দায়িত্ব পাহাড়কে সামলে রাখা।”
পাহাড়ে হিংসাত্মক আন্দোলন নতুন কিছু নয়। জিএনএলএফ প্রধান সুবাস ঘিসিংয়ের আমলে টানা বন্ধের আগে থেকেই পুলিশের উপরে চাপ বাড়াতে বহু বাংলো পোড়ানো হতো। পুলিশ আক্রমণের ঘটনাও কম নয়। ১৯৮৭ সালে অশান্তি শুরু হলে কার্শিয়াং, কালিম্পঙে গুলি চলে। আক্রান্ত হয় কার্শিয়াঙের এসডিও-র বাংলো। পাহাড় জুড়ে হাঙ্গামায় হতাহতের সংখ্যা ছিল অনেক।
ওই সময়ে ঘিসিংয়ের অন্যতম বিশ্বস্ত সেনাপতি হিসেবে পরিচিত ছিলেন এখনকার মোর্চা প্রধান বিমল গুরুঙ্গ। লাগাতার বন্ধ, আন্দোলনের পরে পাহাড়ে কর্তৃত্ব কায়েম করলেও শেষ পর্যন্ত ষষ্ঠ তফসিল আদায়েই থমকে যায় ঘিসিংয়ের বিজয় রথ। আর তা করার পরেও গুরুঙ্গদের বিরোধিতায় পাহাড়ে ঢুকতে পারেননি ঘিসিং। তখন থেকেই তিনি পাহাড়-ছাড়া। |
|
দিল্লির পথে বাগডোগরা বিমানবন্দরে রোশন গিরি। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র |
সেই বিধ্বংসী আন্দোলনের ইতিহাস গুরুঙ্গ ও তাঁর অনুগামীদের বিলক্ষণ মনে রয়েছে। তাই মোর্চার একাংশ এখন বেপরোয়া নেতা-কর্মীদের সংযত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু জিএনএলএফ, সিপিআরএমের মতো দল যাতে ফের প্রাসঙ্গিকতা ফিরে না পায়, সে জন্য তুমুল সংঘাতের পথেই হাঁটতে মরিয়া মোর্চার কট্টরপন্থীরা। এ নিয়ে দু’পক্ষের বিরোধ বাড়লেও এক জায়গাতেই আটকে যাচ্ছে সব পক্ষ। তা হল, কেন্দ্র বা রাজ্যের তরফে আলোচনার ডাক না পেলে কী ভাবে বন্ধ তোলা যাবে? নিদেনপক্ষে সিআরপি প্রত্যাহারের আশ্বাস পেলেও বন্ধ তোলার উপায় মিলতে পারে বলে মোর্চার একাংশের বক্তব্য। দিল্লি পৌঁছে রোশনও সেই ইঙ্গিত দিয়েই বলেছেন, “সব ঠিকঠাকই চলছিল। বন্ধ শিথিলও হচ্ছিল। সিআরপি আনার কী দরকার ছিল? রাজ্য ও কেন্দ্র বিষয়টা নিয়ে ভাবুক।”
রাজনৈতিক ভাবেও বনধ মোকাবিলায় নামল শাসক দল তৃণমূল। দলের সর্বভারতীয় সম্পাদক মুকুল রায় এ দিন শিলিগুড়িতে পাহাড়ের তৃণমূল নেতাদের নিয়ে বৈঠক করে এলাকায় সংগঠন বাড়ানোর নির্দেশ দেন। তৃণমূল নেতা তথা প্রাক্তন জিএনএলএফ কাউন্সিলর রাজেন মুখিয়া বলেন, “পাহাড়বাসী বন্ধ, অশান্তি চান না। সেটা জিএনএলএফ আমলেই বোঝা গিয়েছে। এ বার গুরুঙ্গরাও বুঝবেন।”
জিটিএ-র সভাও চালু রেখে চাপ বাড়াতে চাইছে প্রশাসন। সরকারের মুখপাত্রের দাবি, গুরুঙ্গ পদত্যাগ করেছেন বলে জিটিএ-র সভা বাতিল হয়নি। কারণ, অন্য সদস্যরা ইস্তফা দেননি। জিটিএ আইনে ওই আঞ্চলিক প্রশাসনের প্রধান ইস্তফা দিলে এক মাসের মধ্যে নতুন প্রধান নির্বাচনের সংস্থান রয়েছে। আইন অনুসারে, তত দিন জিটিএ-র কার্যনির্বাহী প্রধান হিসেবে কাজ করবেন উপ-প্রধান কর্নেল রমেশ আলে।
|
পুরনো খবর: দিনভর নাটক শেষে টানা
বনধের ঘোষণা গুরুঙ্গের |
|
|
|
|
|