বনধ কবে উঠবে, কেউ জানে না। ২৪ ঘণ্টা আগে তাই চাল-ডাল-তেল-নুন মজুতের জন্য মুদির দোকানে ভিড়। এটিএম-এর সামনে লম্বা লাইন, বিকেল পর্যন্ত ব্যাঙ্কে লেনদেন...।
এমনটাই হওয়ার কথা। হলও তাই। কিন্তু শুক্রবার কালিম্পঙের ডম্বর চক, দার্জিলিঙের চকবাজারের সোনার দোকানের সামনেও উপচে পড়ল ভিড়। বনধের বাজারে হঠাৎ গয়না কেনার ধুম পড়ল নাকি?
ভিড়টা অন্য দিনের চেয়ে এতটাই বেশি যে, সেটা প্রশাসনেরও নজর এড়ায়নি। বেলা ১১টা নাগাদ কয়েকটি সোনার দোকানের সামনে ঠাসাঠাসি ভিড় দেখে টহলরত পুলিশকর্মীরা থানায় খবর দেন। হামলা, লুটপাটের আশঙ্কায় পুলিশ ও সাদা পোশাকের গোয়েন্দারা সেখানে হাজিরও হন। তখনই স্পষ্ট হয় আসল কারণটা।
গয়না কিনতে নয়, মানুষ ভিড় জমিয়েছেন গয়না বন্ধক দিতে। গয়না বাঁধা রেখে নগদ টাকা নিয়ে তবে চাল-ডালের জোগাড় করছেন। দার্জিলিঙের একজন পদস্থ পুলিশ কর্তার কথায়, “পাহাড়ের গরিব ও মধ্যবিত্তদের একটা বড় অংশের দুর্ভোগটা কোন পর্যায়ে তা বোঝাই যাচ্ছে।”
অনির্দিষ্ট কালের বনধ কত দিন চলবে, ঠিক নেই। পাহাড়ের প্রত্যন্ত এলাকার গাঁ-গঞ্জের মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তদের অনেকেই কমপক্ষে দু-তিন সপ্তাহ খাবারের সংস্থান করতে চান। অথচ জমানো টাকা হাতে নেই। তাই ঘরের সামান্য সোনাদানা বন্ধক রেখে টাকা ধার নিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় রসদ মজুত করছেন ওঁরা। এমনকী মাসের গোড়াতেই বনধ হওয়ায় অনেকে মাইনে পাননি। সরকারি কর্মীদের একাংশও তাই স্ত্রীর গয়না বন্ধক দিয়ে রসদ কিনেছেন। অনেক পরিবারে স্বামী-স্ত্রী সরাসরি মুদির দোকানে গয়না বন্ধক দিয়ে চাল-ডাল নিয়ে গিয়েছেন ঘরে। |
কালিম্পঙের সোনার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছে প্রমীলা ছেত্রী, দীপালি তামাংয়ের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহবধূরা বলছিলেন, “দিনের পর দিন সব অচল রাখলে বাঁচব কী করে? হেঁসেল তো অচল রাখা যাবে না। আর পারছি না।”
টানা বন্ধের সঙ্গে অনেক দিনই পরিচিত পাহাড়বাসী। জিএনএলএফ এক সময়ে কথায় কথায় সপ্তাহব্যাপী বনধ ডাকত। অচল করে দিত পাহাড়। কিন্তু পাহাড়ি গ্রামের ছোটখাটো বাজার খোলা রাখার ব্যাপারে জিএনএলএফ নেতারা আপত্তি করতেন না। কিন্তু মোর্চার আমলে সেই সাহস পাচ্ছেন না দোকানদারেরা। নিজেরাই বললেন, দোকানপাট খোলা রাখলে মোর্চা সমর্থকরা হামলা করবে বলে আশঙ্কা রয়েছে ওঁদের। অতীতে একাধিক দোকানে ভাঙচুরও হয়েছে। ফলে ঝুঁকি নিতে চাইছেন না কেউই।
শনিবার থেকে টানা বনধের হুমকিতে অতি-প্রয়োজনীয় জিনিসের দামও বেড়ে গিয়ে কয়েক গুণ। রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার হাজার টাকাতেও বিক্রি হয়েছে শুক্রবার। ধারধোর করে বাজার করছেন অনেকেই।
কিন্তু দিনমজুরকে কে ধার দেবে? কালিম্পঙের ভালুখোপ এলাকার দিনমজুর ভনে লামা ও তাঁর স্ত্রী রূপা তাই সাতসকালে শেয়ার জিপ ধরে ডম্বর চকের সোনার দোকানে সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। দোকান খুললে বিয়ের বালা-হার-আংটি বন্ধক দিয়ে ১০ হাজার টাকা নিয়েছেন। তা দিয়ে চাল-ডাল, আনাজ কিনে শেয়ার জিপেই ফিরে গিয়েছেন। পাহাড়ের এক সোনার দোকান মালিক বললেন, “আমরা কিন্তু সুদের ব্যবসা করি না। পাহাড়ি মানুষের অসুবিধের সময়ে পাশে দাঁড়াতে চাই। বনধ উঠে গেলে যদি ওঁরা ধীরে ধীরে টাকা দিয়ে দেন তা হলেই হবে। আমরা বড়জোর মাসে ১ শতাংশ সুদ নেব।”
টাকা জোগাড় হলেও নিস্তার নেই। পাহাড়ের তিন মহকুমার বাজারে আলু-পেঁয়াজ-আদা-লঙ্কা দুপুরের মধ্যেই অমিল। দিনভর টহলে ব্যস্ত থাকার পরে বিকেলে বাড়ির জন্য আনাজপাতি কিনতে গিয়ে মাথায় হাত পড়ে গেল অনেক পুলিশকর্মীর। দার্জিলিং সদর থানা, কার্শিয়াং-মিরিক-কালিম্পং থানার অফিসার-কর্মীদের কয়েক জন আক্ষেপ করে বলেন, “চাল পেলেও ডাল-আলু-পেঁয়াজ পাইনি। স্কোয়াশের ঝোলই খেতে হবে ক’দিন।” এক প্রবীণ ইনস্পেক্টরের সংযোজন, “অবশ্য যদি খাওয়ার সময় পাই!”
টানা বনধের ঘোষণায় এমন নানা সমস্যায় পাহাড়ে নানা মহলে ক্ষোভ দানা বাঁধছে। খবর মোর্চার নেতাদের সকলের কাছেই পৌঁছেছে। হয়তো সে কারণেই ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টায় মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, “অনির্দিষ্ট কালের বন্ধ সকলকেই অসুবিধেয় ফেলবে। কিন্তু বড় মাপের আন্দোলনের জন্য সকলকেই আত্মত্যাগ করতে হবে। আমিও জিটিএ-এর পদ ও সরকারি সব সুবিধা ছেড়েছি। একটু সহ্য করুন। নিশ্চয়ই লক্ষ্য পূরণ করতে পারব।”
|